السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

রসূল (স.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণ

| comments

দশম হিজরীর ৯ যিলহজ্ব শুক্রবার দিন ভোরে নামায পড়ে আরাফাতের দিকে রওয়ানা হলেন রসূল (স.)। ঐদিনটিই ছিল ইসলামের গৌরব এবং মর্যাদা বিকাশের দিন। যার ফলে অন্ধকার যুগের যাবতীয় অহেতুক ও বাতিল কাজকর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেল। রাসূলে পাক (স.) এরশাদ করলেন, জেনে রেখ, অন্ধকার যুগের সব দস্তুর ও লোকাচার আজ আমার পদতলে সংস্থাপিত হল। রাসূলে পাক (স.) এরশাদ করলেন, হে লোকগণ! অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতাও এক; সুতরাং কোন আরবের আজমের ওপর প্রাধান্য নেই। শ্বেতবর্ণের লোকের কালো বর্ণের লোকের ওপর এবং কালো বর্ণের লোকের শ্বেত বর্ণের লোকের ওপর কোনই প্রাধান্য নেই; কিন্তু তাকওয়া ও পারহেজগারী হল মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড।

তার পর রাসূলে পাক (স.) বললেন, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই এবং সব মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। অতঃপর রাসূলে পাক (স.) বললেন, হে লোকগণ! তোমাদের গোলাম, তোমাদের গোলাম! যা তোমরা নিজেরা ভক্ষণ করবে তা তাদেরকেও খেতে দেবে। যা তোমরা পরিধান করবে তা তাদেরকেও পরিধান করাবে। আরবে কোন বংশের কেউ যদি কারো হাতে নিহত হত তবে এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা বংশের ওপর অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াত। এমনকি হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এই ফরজ অবশিষ্ট থাকত। এতে করে যুদ্ধ ও রক্তপাতের এক অনন্তকালীন অধ্যায়ের সূচনা হত। এ কারণে আরবের যমিন সর্বদাই রক্তরঞ্জিত থাকত। তাই এসব আরবের পুরাতন পদ্ধতি ও লোকাচার, আভিজাত্যবোধ, বংশের গৌরব গাঁথার রেশ সর্বাংশে খতম করা হল। এর জন্য নবুয়তের এই ঘোষণা বিশ্ববাসীর সামনে সত্যিকার আদর্শের নমুনা পেশ করল। এই প্রেক্ষিতে ঘোষণা করা হল, অন্ধকার যুগের সব রক্তপাত বাতিল করে দেয়া হল এবং সর্বপ্রথম আমি আমার বংশের রক্ত অর্থাৎ রাবীআ বিন হারেছ-এর রক্তশোধ বাতিল ঘোষণা করলাম। ঘোষণা করা হল অন্ধকার যুগের সর্বপ্রকার সুদের কারবার বাতিল করা হল এবং সর্বপ্রথম আমার নিজের বংশের সুদ অর্থাৎ আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদী কারবার বাতিল ঘোষণা করা হল। স্মরণ রাখা দরকার যে, রাসূলে পাক (স.)-এর চাচা আব্বাস (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সুদের কারবারে জড়িত ছিলেন। সেসময় সব লোকের কাছেই তিনি সুদের টাকা পাওনাদার ছিলেন। রাসূলে পাক (স.) তা বাতিল করে দিলেন। ঘোষণা করলেন, তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। অবশ্যই তাদের হক তোমাদের ওপর আছে এবং তোমাদের হকও তাদের উপর আছে। আরবের জান ও মালের কোন মূল্য ছিল না। তারা ইচ্ছানুযায়ী যাকে ইচ্ছা তাকেই হত্যা করত এবং মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হত। তাই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদানকারী সম্র্রাট রাসূলে পাক (স.) সারা দুনিয়ার সামনে সন্ধি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করলেন এবং ঘোষণা করলেন, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের রক্ত কেয়ামত পর্যন্ত এমনি হারাম, যেমন এই মাসে, এই দিনে, এই স্থানে এইসব বস্তু হারাম। এই নির্দেশ তোমাদের আলস্নাহ পাকের সামনে হাজির হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। ঐ বস্তুটি হল, আল্লাহর কিতাব। এরপর রাসূলে পাক (স.) কতিপয় বিধান জারি করলেন। হুকুম করা হল, আল্লাহ পাক সব হকদারকে তাদের ন্যায্য হক প্রদান করেছেন; সুতরাং এখন কোন উত্তরাধিকারীর জন্য অছীয়ত করবার দরকার নেই। জেনে রেখো, ছেলে ঐ ব্যক্তির বলেই সাব্যস্ত হবে যার শয্যায় সে জন্ম লভ করেছে। আর ব্যভিচারের শাস্তি হল প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা এবং তার হিসাব আল্লাহ পাকই গ্রহণ করবেন। আর যে ছেলে নিজের পিতার বদলে অন্য কারো ঔরসে জন্ম নিয়েছে বলে দাবি করে এবং গোলাম স্বীয় মনিব ছাড়া অন্য কারো মালিকানায় নিজেকে সংযুক্ত করে তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত। আর মহিলাদের স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের সম্পত্তি ছাড়া কোন কিছু দান করা জায়েয নয়। ধার করা বস্তু অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। উপহারের বদলা উপহার প্রদান করতে হবে এবং কোন বস্তুর জিম্মাদার হলে এর পরিপূরণ অবশ্যই তাকে করতে হবে। রাসূলে পাক (স.)-এর আরাফাতের ময়দানে ভাষণদানকালেই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, "আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নি'মাতী ওয়া রাদ্বীতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা।" অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামত তোমাদের ওপর পরিপূর্ণ করলাম। আর তোমাদের ধর্ম হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।

হে লোক সকল! তোমরা কি জান আজকের দিনটি কোন্ দিন? লোকজন উত্তর করল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলে পাক (স.) দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ রইলেন। এতে লোকজন মনে করল, হয়তো রাসূলে পাক (স.) এই দিনটির নতুন করে কোন নামকরণ করবেন। দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর রাসূলে পাক (স.) বললেন, এটা কি কুরবানীর দিন নয়? লোকজন বলল, অবশ্যই কুরবানীর দিন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন্ মাস? লোকজন পূর্ববৎ উত্তর দিল। রাসূলে পাক (স.) অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এটা কি যিলহজ্জের মাস নয়? লোকজন বলল, হঁ্যা, নিশ্চয়ই যিলহজ্জ মাস। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, বল দেখি এটা কোন্ শহর? লোকজন আগের মতই উত্তর দিল। রাসূলে পাক (স.) দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বললেন, এটা কি শহরে হারাম নয়? লোকজন বলল, হঁ্যা, অবশ্যই সম্মানিত শহর। যখন শ্রোতাদের মনে এই দিন, এই মাস ও এই শহরের মর্যাদা ও সম্মান নতুন করে জেগে উঠল এবং তারা বিশ্বাস করল যে, এই দিনে, এই মাসে, এই শহরে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত জায়েয নয়, তখন তিনি এরশাদ করলেন, তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের ইযযত-হুরমত (কিয়ামত পর্যন্ত) এভাবেই পবিত্র। যেমন-এই দিন, এই মাস ও এই শহর সম্মানিত ও পবিত্র। তিনি বুলন্দ আওয়াজে ঘোষণা করলেন, হে লোকগণ! তোমরা পরে যেন গোমরাহ হয়ে যেও না, একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। তোমাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে তোমাদের কৃত-কর্মের ব্যাপারে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, জেনে রেখ, অপরাধী নিজের অপরাধের জন্য দায়ী থাকবে আর পিতার অপরাধের ভার ছেলে বহন করবে না। এমন কি ছেলের অপরাধের জবাবও পিতাকে দিতে হবে না। রাসূলে পাক (স.) এরশাদ করলেন, যদি হাবশী অন্ধ গোলামও তোমাদের আমীর হয় এবং আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করে, তবে তার ফরমাবরদার হওয়াও তোমাদের কর্তব্য। মরু আরবের প্রতিটি ধূলিকণা ইসলামের নূরে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এবং খানায়ে কা'বা চিরকালের জন্য মিল্লাতে ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

সত্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যাবতীয় অশুভ বস্তু নিমর্ূল হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাসূলে পাক (স.) এরশাদ করেছিলেন, জেনে রেখ, শয়তান অবশ্যই জেনে গেছে যে, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদের এই শহরে তার ইবাদাত-বন্দেগী কখনো হবে না। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ছোট-খাট কাজে তোমরা তার পায়রবী করলেও এতেই সে সন্তুষ্ট থাকবে। সর্বপ্রথম রাসূলে পাক (স.) ইসলামের প্রাথমিক ফরজগুলো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। একই সাথে এরশাদ হল, "স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদাত করবে। পাঁচ ওয়াক্তের নামায আদায় করবে, রমজান মাসের রোযা রাখবে এবং নেতা ও আমীরের নির্দেশাবলীর আনুগত্য করবে। তাহলে তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে।" আমি তোমাদের মাঝে দুইটি বস্তু রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরলে কখনো কেউ পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো কুরআন ও আমার সুন্নাত। এতটুকু বলার পর তিনি জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কি তোমাদের কাছে আলস্নাহর পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি? সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। অতঃপর জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করে বললেন, যারা এখন এখানে উপস্থিত আছো, তারা এই ভাষণ অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবে যারা এখানে উপস্থিত নেই। খুৎবাহর শেষ পর্যায়ে তিনি সব মুসলমানকে লক্ষ্য করে বললেন, বিদায়, বিদায়।

_মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template