প্রশ্নঃ মিরাস বলতে আমরা কি বুঝি?
উত্তরঃ মিরাস আরবী শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে মৃতের রেখে যাওয়া সম্পদ। যা একজন পুরুষ বা মহিলা তার মৃতু্যর সময় রেখে যায়।
প্রশ্নঃ মুসলিম সমাজে মিরাসের গুরুত্ব কতটুকু?
উত্তরঃ মুসলিম সমাজে মিরাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এই মিরাস বা মৃতের রেখে যাওয়া সম্পদের যদি সুষ্ঠুভাবে বিলি-বন্টন না হয় তাহলে সেই সমাজে অর্থনৈতিক অস্থিরতা নেমে আসতে বাধ্য হয়। সমাজের একটি বৃহত্তর অংশের কাছে ধন সম্পদের সিংহভাগ কুক্ষিগত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অপর অংশ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ঘটে, শান্তি বিঘি্নত হয় ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হওয়ার মত নিন্দনীয় ঘটনা সংঘটিত হয়। অথচ রাসূল (স.) বলেছেন, 'আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।'
প্রশ্নঃ মিরাস সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে কী বলা হয়েছে? রসূল (সঃ) ও সাহাবীদের জীবনে মিরাসের বাস্তব প্রতিফলন কিভাবে ঘটেছিল?
উত্তরঃ কুরআন ও হাদীসে মিরাস সংক্রান্ত বিষয়ে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, 'হে নবী (স.) মানুষেরা আপনাকে মিরাস সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছে, আপনি বলুন এ ব্যাপারে আলস্নাহতায়ালা পরিষ্কার বর্ণনা করেছেন। যদি কোন পুরুষ লোক মারা যায় এবং তার কোন সন্তানাদি না থাকে এবং এক বোন থাকে তাহলে সে পাবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধেক অংশ। আর সে যদি নিঃসন্তান হয় তবে তার ভাই উত্তরাধিকারী হবে। আর দুই বোন থাকলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবে। পক্ষান্তরে যদি এক ভাই থাকে তবে বোন যা পাবে ভাই পাবে তার দ্বিগুণ। তোমরা বিভ্রান্ত হবে বলে আলস্নাহ তোমাদের সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন (সুরা নিসা-১৭৬ আয়াত)। হাদীসে এসেছে 'হযরত আওস ইবনে সাবিত আল আনসারী (রা.) ইন্তেকালের সময় স্ত্রী উম্মে কাহ্লা ও তিন কন্যা সন্তান রেখে যান। এমতাবস্থায় জাহেলীযুগের রীতি অনুযায়ী তাঁর দুই চাচাতো ভাই তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়। এই ঘটনা রসূল (স.) এর নিকট পেঁৗছলে রসূল (স.) চাচাতো ভাইদেরকে ডাকলেন। তখন তারা বলল- 'ইয়া রাসূলুলস্নাহ (স.) মৃতের স্ত্রী ও কন্যারা না ঘোড়ায় চড়তে পারে না বোঝা বইতে পারে আর না শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। সবইতো আমাদেরকেই করতে হয়। সুতরাং মৃতের যাবতীয় সম্পত্তির প্রকৃত হকদার আমরাই। তখন মিরাস সংক্রান্ত এই আয়াতটি নাযিল হয়। এখানে বলা হয়েছে, 'পুরুষদের জন্য সেই ধন সম্পদে অংশ রয়েছে যা পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়রা রেখে গেছেন। এবং মহিলাদের জন্যও সেই ধন সম্পদ অংশ রয়েছে যা পিতা-মাতা ও নিকটত্মায়রা রেখে গেছেন। তা অল্প অথবা বেশি হোক আর এ অংশ আলস্নাহ কতর্ৃক নির্ধারিত (সূরা নিসা-৭ আয়াত)।
প্রশ্নঃ এত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়। তা কেন মুসলিম সমাজে এড়িয়ে যাওয়া হয় ? এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণও কেন এটি বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার হয় না? তবে কি ইসলাম ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার ব্যাপারে অনুমতি দেয়?
উত্তরঃ এর মূল কারণ হলো ধন সম্পদের প্রতি আসক্তি চরমভাবে প্রবৃদ্ধি পাওয়া। মানুষ কখনো অল্পে তুষ্ট হতে চায় না। বেশিরভাগ মানুষ চায় বৈধ উপায়ে হোক আর অবৈধ উপায়ে হোক পাহাড়সম সম্পদ তার চাইই। পুঁজিবাদী প্রবৃত্তির এটাই প্রকৃতি। এ ধরনের স্বভাব যাদের রয়েছে তারা যত বড় আলেম বা বুজুর্গই হোক না কেন সে ওয়ারিশ ঠকিয়ে হোক বা অন্য উপায়ে হোক নিজেদের বিলাসী জীবনের জন্য নানারকম সামগ্রির স্তূপ গড়ে তুলবেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজ খুবই গর্হিত। এদের পরিণতি সম্পর্কে কঠিন সাবধান বাণী এসেছে, 'যে ধন সম্পদ জমা করে এবং বারবার তা গণনা করে, সে মনে করে তার সম্পদ তাকে চিরজীবী করবে, কখনোও নয়; বরং সে নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়, আর হুতামা কি তা কি তুমি জান? তা আলস্নাহর প্রজ্জলিত আগুন। যা হূৎপিণ্ড পর্যন্ত পেঁৗছে দেবে (সূরা হুতামা-২-৭)। ধন সম্পদের প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাথে সাক্ষাৎ করবে (সূরা তাকাসূর)। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হলো যে, ধন লিপ্সা মানুষকে ন্যায়-অন্যায় বা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। আর এই মানসিকতার লোকেরাই মিরাসের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। আলেম সমাজ ও কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও মিরাসের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। আসলে উচিত ছিল, যে সমস্ত অন্যায় ঈমানদারদের আমল বিনষ্ট করে দেয় সে ধরনের গুরুতর অন্যায় হতে আলেমদেরকে সাবধান করা। তাদের নীরব ভূমিকার কারণে মুসলিম সমাজে দিনে দিনে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা সংক্রমিত হচ্ছে।
প্রশ্নঃ মিরাসী বিধানের ক্ষেত্রে ইসলাম কি নারীদেরকে ঠকিয়েছে? তা না হলে তাদের কি কি অধিকার দেয়া হয়েছে? বিশেস্নষণ করবেন কি?
উত্তরঃ না, ইসলাম কোন ক্ষেত্রেই নারীদেরকে ঠকায়নি। বরং অধিকার বঞ্চিত নারী জাতিদেরকে ইসলামই প্রথম তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। প্রাক-ইসলামী যুগে নারীদের কোন মানবিক অধিকার ছিল না। তারা কেবল পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার হতো। কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখা হতো। ইসলামই তাদেরকে গর্তের মধ্য থেকে বের করে মর্যাদার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বিবাহ ও তালাকের মাধ্যমে তাদের দাম্পত্য জীবনে শৃংখলা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিবাহের সময় দেনমোহর প্রবর্তিত হওয়ায় তারা অর্থনৈতিক দিক হতে নিশ্চিন্ত হয়েছে। তাছাড়া যাবতীয় ব্যয়ভার স্বামীর ওপর অর্পণ করে তাদেরকে অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাছাড়া পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুত্রের অর্ধেক কন্যার জন্য নির্ধারণ করার বিষয়টি বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও মনে হয় এখানে নারীকে ঠকানো হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঠকানো হয়নি। কেননা একজন কন্যা যদিও পৈত্রিক সম্পত্তিতে ভাইয়ের অর্ধেক পেয়ে থাকে, তবুও এখানেই শেষ নয়। তাকে কিন্তু আরো অনেক ক্ষেত্র হতে উত্তরাধিকার সম্পত্তি প্রদান করা হয়েছে। যেমন স্বামীর সম্পত্তি, মায়ের সম্পত্তি। তাছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে এই কন্যা-মা, দাদী, নানী, পৌত্রী, বৈপিত্রেয় বোন ও বৈমাত্রেয় বোন ইত্যাদি। তাছাড়া কুরআনে কারীমে যবিল ফুরুজ হিসেবে যে ১২ জন উত্তরাধিকারীর কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ৮ জনই নারী। তারা হলেন, স্ত্রী, কন্যা, পৌত্রী, সহোদরা বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় বোন, মা, দাদী, নানী। পক্ষান্তরে পুরুষদের মধ্যে পিতা, দাদা ও তদূধর্্ব বৈপিত্রেয় ভাই ও স্বামী। উপরন্তু নারীর ভরণ-পোষণসহ তার সকল ব্যয়ভার পুরুষই নিয়ে থাকে। তাছাড়া নারীর কোন ব্যয়ের খাত নেই। সবই আয়। আর পুরুষটি কেবলমাত্র পিতার সম্পত্তিতেই বোনের দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়। কিন্তু সংসারের যাবতীয় ব্যয়ভার তার উপরই বর্তায়। এমনকি পিতার মৃতু্যর পর বোন যখন বাপের বাড়ীতে বেড়াতে আসে অথবা কোন কারণে যদি তাকে স্বামীর বাড়ী ছেড়ে ভাইয়ের বাড়ীতে উঠতে হয় তখন সেই বোনের ব্যয়ভারও মানবিক কারণে ভাইকেই বহন করতে হয়। তারপরও কি বলা যাবে ইসলাম নারীদেরকে ঠকিয়েছে? না বলা যাবে না। এছাড়া কেউ কেউ বলেন, আলস্নাহ কেন নারীদের মধ্যে হতে কাউকে নবী বানান নি ? কথাটি ঠিক কিন্তু পাশাপাশি একথাও ঠিক যে, আলস্নাহতায়ালা নবী রাসূলদেরকে নারীদের গর্ভজাত করে তাদের মা বানিয়েছেন। হাদীসের ভাষায় যে মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। স্বয়ং আলস্নাহতায়ালা নারী অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য কুরআন শরীফ জুড়ে অসংখ্য আয়াত নাযিল করেছেন। এমনকি সূরা নিসা অর্থাৎ নারী নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন যার অধিকাংশ আয়াত নারী অধিকার সংক্রান্ত।
প্রশ্ন: ইসলাম ইয়াতিম, বিধবা ও সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য কি দিয়েছে?
উত্তর: তাদের ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে, "তোমরা ইয়াতিমদের সাথে ভাল ব্যবহার কর (সূরা নিসা ৩৬ আয়াত)। যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ করে তারা মূলত: আগুন দিয়ে তাদের পেট ভর্তি করে" (সূরা নিসা-১০ আয়াত)। তোমরা আত্মীয়, মিসকিন ও সহায়-সম্বলহীন পথিককে তার অধিকার ফিরিয়ে দাও" (সূরা ইসরা ২৬ আয়াত)। তাদের (ধনীদের) সম্পদে প্রাথর্ী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে (সূরা জারিয়াত ১৯ আয়াত)। যাঞ্চাকারী বা ভিক্ষুককে তিরস্কার করো না" (সূরা দুহা-১০ আয়াত)। এ বিষয়ে হাদীস শরীফে এসেছে-রাসূল (স.) বলেছেন, "মুসলমানদের মধ্যে সেই ঘরটি উত্তম যে ঘরে ইয়াতিমের সাথে ভাল ব্যবহার করা হয়। আর সেই ঘরটি নিকৃষ্ট যে ঘরে ইয়াতিমের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়" (ইবনে মাজাহ্)। সাফওয়ান ইবনে সুলাইম (রা.) বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন," বিধবা ও গরীব মিসকিনদের সাহায্যার্থে চেষ্টা সাধনাকারী ব্যক্তি আলস্নাহর পথে সেজদারত অথবা যে ব্যক্তি দিনভর রোজা রাখে এবং সারারাত নামাজরত দাঁড়িয়ে কাটায় তাদের সমান" (বুখারী)। অন্যত্র রাসূল (স.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহকারে আহার করবে অথচ তারই প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত থাকে সে মুমিন নয়" (মেশকাত)।
প্রশ্ন: বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অধিক মুনাফালাভের উদ্দেশ্যে খাদ্য মওজুদ করে রেখে সংকট মুহূর্তে চড়াও মূল্য হেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছে। তাছাড়া যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায়, ওজনে কম দেয় তাদের পরিণতি কি হবে?
উত্তর: অধিক মুনাফালাভের উদ্দেশ্যে খাদ্য গুদামজাত করা, ভেজাল মেশানো ও ওজনে কম দেয়া ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সংকট অবস্থায় ৪০ দিনের বেশি যে কোন খাদ্যদ্রব্য মওজুদ করে রাখার অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয়নি। ওজনে কম দেয়ার ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে, 'ধ্বংস তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়।' (সূরা মুতাফিফীন-১ আয়াত)। ভেজালের ব্যাপারে প্রিয়নবী (স.) কঠোর দৃষ্টি রাখতেন। তিনি নিজেই বাজার তদারক করতেন। একবার এক ভেজালপ্রদানকারীকে হাতেনাতে ধরে তাকে বলেছিলেন, 'খবরদার! এ কাজ আর কখনো করো না। আর জেনে রেখ যে ব্যক্তি এ ধরনের কাজ করবে সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম)
০মাওলানা মুফাজ্জল হুসাইন খান
সাক্ষাৎকার গ্রহণে:মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী,
Post a Comment