বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী, সারওয়ারে কাওনাইন, রাহমাতুল্ লিল্ আলামীন, শাহানশাহে আরব ও আজম বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পৃথিবীতে শুভাগমন নিঃসন্দেহে ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। রূহানী দুনিয়া থেকে বস্তুজগতে মহানবীর (সা.) আবির্ভাব সত্যি সত্যিই বিশ্বস্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীনের এক অপরূপ করুণা। তাঁর আগমনে শিরক, পৌত্তলিকতা, জাহেলিয়াত ও বর্বরতা দূরীভূত হয়। তাঁর শুভাগমনে বিশ্বের সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এমন মহামানবের জীবনচরিত আলোচনা একটি বড় এবাদত। তাঁর পবিত্র জীবনের প্রতিটি ঘটনা মানুষের হেদায়েতের জন্য উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিক এবং সীরাতকারগণের মধ্যে যদিও মতভেদ রয়েছে, তথাপি তারা এ বিষয়ে একমত যে, মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম পক্ষে সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তা ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যকার কোনো একদিন ছিল।
সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গাম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মহান রাব্বুল আলামীন এমন এক সময় পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যখন আরবসহ গোটা বিশ্ব অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। সে সময় মানবতা, সভ্যতা ও ইনসাফ সমাজে ছিল অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'য়ালা মহানবী (সা.)-কে উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং অতুলনীয় মানবিক গুণাবলী দান করে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করেন। হজরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রথম থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার খেদমতে ছিলেন। হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) একদিন তাঁর কাছে মহানবী (সা.)-এর চরিত্র ও স্বভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি বলেন, 'তিনি হাসিমুখ, নম্র স্বভাব ও দয়ালু প্রকৃতির লোক ছিলেন; কঠোর স্বভাব, সংকীর্ণ হৃদয়ের ছিলেন না। কথায় কথায় কলহ করতেন না, কোনো প্রকারের মন্দ বাক্য কখনো উচ্চারণ করতেন না। ছিদ্রান্বেষী ও ক্ষুদ্রমনা ছিলেন না, কোনো কথা তার পছন্দ না হলে তা থেকে বিরত থাকতেন। তাঁর কাছে কেউ কোনো কিছুর আবদার করলে তাকে নিরাশ করতেন না। নামঞ্জুরির কথাও প্রকাশ করতেন না। অর্থাৎ, প্রকাশ্যভাবে নিষেধ বা প্রত্যাখ্যান করতেন না। বরং তা পূরণ করা সম্ভব না হলে নীরব থাকতেন। ফলে বিচক্ষণ ব্যক্তিরা সে নীরবতার মধ্যে উদ্দেশ্য বুঝে নিতে পারত। তিনি নিজের জীবন থেকে তিনটি বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে দূর করেছিলেন। যেমন, পরস্পরে কূটতর্ক করা, প্রয়োজনাতিরিক্ত কথা বলা এবং লক্ষ্যহীন কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকা। অপর লোকদের ক্ষেত্রেও তিনি তিনটি বিষয়ে সংযমী ছিলেন। কাকেও মন্দ বলতেন না, কাকেও দোষারোপ করতেন না এবং কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকতেন না। যে কথা মানুষের কল্যাণকর তাই বলতেন। কথোপকথনের সময় সাহাবীরা এমন নীরব ও নতশিরে তা শুনতেন, যাতে মনে হতো যেন তাদের মাথায় পাখি বসে আছে। যখন তার কথা বলা শেষ হতো তখন সাহাবীরা পরস্পরের কথাবার্তা বলতেন। কেউ কোনো কথা বলা আরম্ভ করলে তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নীরবে শুনতে থাকতেন। যে কথায় মানুষ হাসত, তিনিও সে কথায় মুচকি হাসতেন। যাতে মানুষ বিস্মিত হতো, তিনিও তাতে বিস্মিত হতেন। বহিরাগত কোনো ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে কথা বললে তা তিনি সহ্য করে নিতেন। লোকমুখে নিজের প্রশংসা শোনা পছন্দ করতেন না। কিন্তু যদি কেউ অনুগ্রহ ও দানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত, তা গ্রহণ করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তার কথা বলা শেষ না করত, ততক্ষণ তার মাঝে ছেদ টানতেন না। তিনি অত্যন্ত উদার, সত্যবাদী ও অতিশয় নম্র স্বভাবী ছিলেন। তাঁর সাহচর্য ছিল মহোত্তম। তাঁর এমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা ছিল যে, অকস্মাৎ দেখলে অন্তর কেঁপে উঠত। কিন্তু যতই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে থাকত, ততই ভালোবাসা দৃঢ়তর হতো। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোলে লালিত হিন্দ ইবনে আবীহাল্লা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নম্র স্বভাবী ছিলেন, কঠোর প্রকৃতির ছিলেন না। কারও প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা ভালো মনে করতেন না। সামান্য বিষয়েও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। কোনো বস্তুকেই খারাপ বলতেন না। যে কোনো খাদ্যদ্রব্য সামনে হাজির করা হলে তা গ্রহণ করতেন এবং ভালোমন্দ কিছুই বলতেন না। যদি কেউ সত্যের বিরোধিতা করত, তাহলে রাগান্বিত হতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত কাজে তার পূর্ণ সহযোগিতা করতেন। ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনো তার ক্রোধের উদয় হতে দেখা যায়নি এবং কারও কাছ থেকেও প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে মহানবী (সা.) এর অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী; খতিব, মালিবাগ বায়তুল আজিম শহীদী জামে মসজিদ, ঢাকা।
Post a Comment