মূলত ধর্মের সর্বজনস্বীকৃত কোন সংজ্ঞা নেই। তার কারণ পৃথিবীতে বিচিত্র রকমের ধর্মবিশ্বাস প্রচলিত। এমন কোন সংজ্ঞা দেয়া যায় না যা সব ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে বেশিরভাগ ধমর্ীয় পন্ডিত ব্যক্তি মনে করেন ধর্ম হলো কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস অথবা ধর্ম হলো অদৃশ্য শক্তির উপর আত্মসমর্পণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তা থেকে আমার মনে হচ্ছে যে, ধর্ম হলো- "একটি পথ যা মানুষকে আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরী করে এবং সব রকম দুঃখ-বেদনা দূর করে চিরমুক্তির পথ দেখায়"। আর তত্ত্ব হলো যে কোন বিষয় সম্পর্কে একটি বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য।
প্রশ্নঃ ধর্মের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে?
উত্তরঃ ধর্মের যেমন সর্বজনস্বীকৃত কোন সংজ্ঞা নেই, তেমনিভাবে ধর্মের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে এ ব্যাপারে সর্বজনস্বীকৃত কোন মতবাদ নেই। যেমনঃ নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা ধর্মের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বিবর্তনে বিশ্বাস করে। আবার ঐশী ধর্মের অনুসারী ধর্মতত্ত্ববিদরা মনে করেন, ধর্ম হলো পরম স্রষ্টার সৃষ্টি। মানুষের আবির্ভাব থেকেই ধর্মেরও আবির্ভাব হয়েছে। যারা ঐশী ধর্মে বিশ্বাস করেন না মূলতঃ তারাই মনে করেন যে, বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে এবং বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
যেমনঃ সর্বপ্রাণবাদীরা মনে করেন, আদিমকালের মানুষেরা বিশ্বাস করতো যে, সবকিছুর মধ্যে প্রাণ আছে এবং এই বিশ্বাস থেকেই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। মানাবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন কোন কোন দেশের আদিম মানুষ মনে করতো যে, যার মধ্যে একটি বিশেষ শক্তি আছে সেই তাদেরকে রক্ষা করতে পারে। এই শক্তির তারা নাম দিয়েছে "মানা"। এই মতবাদের নাম "মানাবাদ"। আবার অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ভয় থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। যেমনঃ ঝড়, বন্যা, দাবানল, ভূমিকম্প, হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ ইত্যাদি। ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য তারা কোন অজানা শক্তির সাহায্য চেয়েছে এবং সাথে সাথে তার উপাসনা করা শুরু করেছে, সেখান থেকেই হয়ত ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে।
প্রশ্নঃ ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তরঃ প্রথমত, ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। আর দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে বিচার-বিশেস্নষণ। ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন একটি আদর্শ অথবা কোন একটি সত্তার প্রতি অনুরাগ। অন্যদিকে দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান বা সত্যের প্রতি অনুরাগ। ধর্মের সাথে আচার-অনুষ্ঠান সম্পৃক্ত। কিন্তু দর্শনের সাথে আচার অনুষ্ঠানের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম মূলতঃ ভক্তি-নির্ভর। আর দর্শন হলো সম্পূর্ণ যুক্তিনির্ভর।
প্রশ্নঃ ধর্মতত্ত্ব বলতে আমরা কি বুঝি? পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মের তাত্তি্বক বিশেস্নষণ করবেন কি?
উত্তরঃ ধর্মের প্রধান শিক্ষা হলো ক্ষমা করা ও ভালবাসা, যদিও ইসলাম ধর্ম খ্রীষ্ট ধর্মের ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস করে না। তথাপিও ইসলাম ধর্ম যিশু খ্রিষ্টকে যে সম্মান দিয়েছে, তাকে কুমারী মায়ের সন্তান হিসেবে যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, অন্য কোন ধর্ম এভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু তাই নয়, মাতা মেরি বা মরিয়ম-এর নামে কোরআন শরীফে একটি সুরাও আছে। কিন্তু সারাবিশ্বের ৯৯.৯৯ ভাগ খ্রিষ্টান এ বিষয়ে জানে না।
প্রশ্নঃ জীবনের সকল সমস্যার সমাধান কি ধর্মতত্ত্বে ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করা হয়েছে?
উত্তরঃ এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে যে, সমস্যা বলতে আমরা কি বুঝি? আজকের কম্পিউটার যুগে আমরা অনেক প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এ জাতীয় সমস্যার সমাধান কোনো ধর্মগ্রন্থে থাকার কথা নয়। কাজেই আমরা যদি দাবি করি ধর্মই সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে তাহলে আমাদের সেই দাবি এক্ষেত্রে সঠিক হবে না। আর সমস্যা বলতে যদি আমরা আদর্শ জীবন ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা বলি তাহলে এ সমস্যার সমাধান অবশ্য অবশ্যই ধর্মগ্রন্থে আছে। এখানে একটা কথা বলতে পারি যে, একটি ছাগল জন্মেও ছাগল হিসেবে, মরেও ছাগল হিসেবে। তাকে ছাগলত্ব অর্জন করতে হয় না। একথা অন্যান্য পশুপাখির ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। তবে কেবল মানুষের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কেননা একটি মানব শিশু মানুষের সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং পরে তাকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। ধর্ম এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। ধর্মের সঠিক শিক্ষা হচ্ছে- একজন মানুষকে যে গুণগুলো থাকলে সত্যিকারের মানুষ বলা যাবে সেই গুণগুলো অর্জনে সহায়তা করা। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি সত্যিকারের মানুষ হয় তাহলে সমাজ জীবনে বর্তমানে আমরা যে সমস্ত সমস্যা লক্ষ্য করি সেই সমস্যা কোনক্রমেই থাকতে পারে না। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন- যে ব্যক্তি আদর্শ মানুষ হতে পারেনি তার পক্ষে আদর্শ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ বিভিন্ন ধর্মের প্রধান প্রধান ধমর্ীয়গ্রন্থ সম্পর্কে ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি কি?
উত্তরঃ ধর্ম যেমন অনেক ধরনের, ধর্মগ্রন্থও তেমনি অনেক ধরনের। কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থ আছে যা কোন একজন ব্যক্তির বাণী। যেমন বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ "ধমর্্মপদ"। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি কথা গৌতম বুদ্ধের। এভাবে কনফুসিয়াসের বক্তব্যও একই ধরনের। তেমনিভাবে তাওইজমের মূল গ্রন্থ-এর প্রতিটি কথাই লাও যু-এর। আবার শিখ ধর্মের মূল গ্রন্থ "গুরু গ্রন্থ"। এটি ছত্রিশ জন সাধু ব্যক্তির বাণীর সংকলন। এদের মধ্যে শেখ ফরিদ এবং কবিরের লেখাও স্থান পেয়েছে। হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ-এর বাণী ঐশী বাণী নাকি বিভিন্ন ঋষীর বাণীর সংকলন তা নিয়ে হিন্দু পন্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইহুদী ধর্মের মূল গ্রন্থ তাওরাত বা তোরা ঐশী বাণী বাইবেলের প্রথম অংশ। অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্ট-ই হচ্ছে তোরার বর্তমান রূপ। গোঁড়া ইহুদীরা মনে করেন যে, ওল্ড টেস্টামেন্ট তোরার অবিকৃত অবস্থা নয়। খ্রীষ্টানদের বাইবেল অর্থাৎ নিউ টেস্টামেন্ট যিশুর অনুসারী সাধু ব্যক্তিদের ঈশ্বর কতর্ৃক অনুপ্রাণিত লেখার সংকলন। এই ওল্ড টেস্টামেন্টে এবং নিউ টেস্টামেন্টের সাথে কোরআনে বর্ণিত অনেক ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে উলেস্নখ্য যে, অনেক ধর্মগ্রন্থের মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও পবিত্র কোরআনের মৌলিকত্ব নিয়ে আজও সন্দেহসূচক কোন প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ বিগত চৌদ্দশ' বছরেও কোরআনের একটি বর্ণ, শব্দ ও বাক্যে কোন পরিবর্তন সূচিত হয়নি।
প্রশ্নঃ আধুনিক বিশ্বে মানুষের চিন্তা-চেতনায় ধমর্ীয় অনুভূতি বা প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে? না-কি সংকুচিত হচ্ছে? এবং ধর্মের তাত্তি্বক বিশেস্নষণ করবেন কি?
উত্তরঃ একথা ঠিক যে, সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ধমর্ীয় অনুভূতির একটি নব জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, আগে যে পরিমাণ মানুষ মসজিদে যেত এখন সেই তুলনায় অধিক হারে মানুষ মসজিদে এবাদত-বন্দেগীর জন্য সমবেত হয়। মসজিদ, মন্দির, চার্চ কিংবা সিনেগগে আগের তুলনায় উপস্থিতির হার যেমন বেড়েছে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তেমনিভাবে বেড়েছে ধমর্ীয় গোঁড়ামি।
ধর্মতত্ত্বের বু্যৎপত্তিগত অর্থ হলো ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা। কিন্তু সারা বিশ্বে সমকালীন ধমর্ীয় পন্ডিত ব্যক্তিরা মনে করেন যে, এখানে বু্যৎপত্তিগত অর্থ গৌণ। এ শব্দের দ্বারা যে ব্যাখ্যা তারা করেন তা হলো ধর্ম সম্পর্কিত বস্তুনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক এবং তুলনামূলক পর্যালোচনাই ধর্মতত্ত্ব।
প্রফেসর ড. কাজী নূরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার গ্রহণে মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
Post a Comment