হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুলস্নাহ (স.) শৈশব হতেই অনাথ, এতিম, বিধবা ও অভাগাজনদের দুঃখ-বেদনার সাথী ছিলেন। যৌবনের শুরুতেই তার ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা, চরিত্রের নিষ্কলুষতা, সমাজসেবা ও গৌরবময় ব্যক্তিত্বের বিকাশ আরবজাহান তথা সারাবিশ্বের নারী ও পুরুষকে বিমোহিত করে তুলেছিল। দুঃস্থ মানবতার সেবায় তিনি হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য অক্লান্ত সমাজকমর্ী হিসেবে যুবক মুহাম্মদের (স.) নাম ইতোমধ্যেই সিরিয়া ও ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। চাচা আবু তালেবের ব্যবসায়ে সাহায্যকারী হিসেবে তার ব্যবসায় নৈপুণ্য, সততা ও বিশ্বস্ততার কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি প্রখর বিচারবুদ্ধি, ন্যায়পরায়ণতা, ব্যবসায়ে নৈপুণ্য ও সাংগঠনিক কর্মকুশলতার জন্য সর্বত্র প্রশংসিত হতে লাগলেন। তিনি 'আল-আমীন' উপাধিতে বিভূষিত হলেন। তিনি ছিলেন ব্যবসায়-বাণিজ্যে অভিজ্ঞ, বিশ্বস্ততায় অদ্বিতীয়, নির্মল চরিত্র-মাধুর্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আল-আমীন।
হযরত খাদিজা (রা.) যেন সব হারানোর বেদনা ভুলে গিয়ে নতুন আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি আল-আমীনকে স্বীয় ব্যবসায়ের কর্ণধার নিয়োগ করতে চাইলেন। মহামতি আবু তালেব এই প্রস্তাব সানন্দে কবুল করলেন। ফলে যুবক আল-আমীন মুহাম্মদ (স.) হযরত খাদিজা (রা.)-এর বিরাট ব্যবসায়ের পরিচালনার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করলেন। আল-আমীনের কার্যভার গ্রহণ করার পর হযরত খাদিজার (রা.) ব্যবসায়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। আগের চাইতে লভ্যাংশ দ্বিগুণ, ত্রিগুণ ও চতুর্গুণ বেড়ে গেল। পরিচালক আল-আমীনের ন্যায়নীতি, বিশ্বস্ততা, সততা, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র-মাধুর্য তাঁকে বিমোহিত করে তুললো। তিনি নিজের অজান্তে আল-আমীনকে ভালোবেসে ফেললেন। স্থান দিলেন হূদয়ের মণিকোঠায়। ভুলে গেলেন বয়সের কথা। বিস্মৃত হলেন বিগত জীবনের বেদনাভরা ইতিহাস। তিনি নতুন আশায় বুক বাঁধলেন।
হযরত খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায়ী মালামাল নিয়ে আল-আমীন সুদূর সিরিয়া গমন করেছেন। কিন্তু ক্রমেই দিন বেড়ে চলেছে। এখনো ব্যবসায়ী কাফেলা পরিবর্তন করছে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিবি খাদিজার (রা.) মনে কেমন যেন আশঙ্কার বান ডেকে উঠল। তিনি প্রহর গুণতে লাগলেন। কেন এমন হলো? কেন এত দেরি হয়ে যাচ্ছে? না জানি কোন বিপদ ঘটল কি-না, তাই বা কে জানে। আল-আমীনের অদর্শনের বেদনায় তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। হূদয়-মন জুড়ে বয়ে বেড়াতে লাগল বেদনার তপ্ত লোহিত শোণিত বিন্দু। হূদয়ের তারে তারে প্রাণের শোণিত ধারে কে যেন অলক্ষ্যে বলে যেতে লাগল: হে আল-আমীন! ফিরে এসো বন্ধু। এতদিন অদর্শনের ব্যথা আর সহ্য হচ্ছে না।
বিবি খাদিজা (রা.) প্রতিদিন ছাদের ওপরে বসে সিরিয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন। রোদ নেই, তাপ নেই, জ্বালা নেই, কোন কিছুর প্রতি নজর নেই, তিনি একাগ্র মনে চেয়ে থাকেন সেই পথের দিকে, যে পথ বেয়ে আল-আমীন চলে গেছে ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে সিরিয়ার দিকে। দৃষ্টি চলে যায় দূর-দূরান্তে, সুদূর নীলিমার উন্মুক্ত দিকচক্রবালে। কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়, তা তিনি টেরও করতে পারেন না।
ব্যবসায়ের লাভ-লোকসানের হিসেব দেয়ার জন্য আল-আমীনকে (স.) বিবি খাদিজার (রা.) মহলে ডেকে আনা হল। পরম তৃপ্তিসহকারে বিবি খাদিজা (রা.) তাকে আপ্যায়ন করলেন। তারপর বিনম্র কণ্ঠে নিবেদন করলেন, হে আল-আমীন! আপনার সততা ও চরিত্রের নিষ্কলুষতায় আমি বিমুগ্ধ।
তিনি সহচরী নফিসার মাধ্যমে বিবাহের পয়গাম আবু তালেবের কাছে প্রেরণ করলেন। আবু তালেব এই প্রস্তাবে খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং স্বগোত্রের দশজন লোক নিয়ে বিবি খাদিজার চাচা আমর ইবনে আসাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বিবি খাদিজার সাথে আল-আমীনের বিবাহের প্রস্তাব পেশ করলেন। খাদিজার সম্মতি ও পরামর্শক্রমে চাচা আমর বিন আসাদ এই বিয়েতে রাজি হলেন এবং উভয়পক্ষের আলোচনার প্রেক্ষিতে ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে জমাদিউল আউয়াল তারিখে পাঁচশো দেহরাম দেনমোহর ধার্য করে আল-আমীন ও খাদিজা তাহেরার বিবাহের কাজ সম্পন্ন করলেন।
আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বরের পক্ষে আবু তালেব ও কনের পক্ষে ওয়ারাকা-বিন নওফেল খুতবাহ দান করলেন। আবু তালেব তার ভাষণে বললেন- সকল প্রশংসা আলস্নাহপাকেরই জন্য, যিনি আমাদেরকে ইব্রাহীম ও ইসমাইলের বংশধর হবার গৌরব প্রদান করেছেন। যিনি আমাদেরকে বায়তুলস্নাহ শরীফের খাদেম হিসেবে কবুল করেছেন এবং হেরেম শরীফের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন। যিনি আমাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিপালন করেছেন। তাছাড়া আমাদেরকে অন্যান্য লোকের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আপনারা অবশ্যই জানেন আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুলস্নাহর নন্দন আল-আমীন মুহাম্মদ (স.) নিঃসম্বল, এতিম হিসেবে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করছে। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী বিত্ত-বৈভব যদিও তার নেই, তবু তার দেহ-সৌষ্ঠব, পবিত্র-চরিত্র, মধুর আচরণ, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, মহান হূদয় সম্পর্কে সকলেই সুবিদিত। এর ফলেই তাহেরা খাদিজা তাঁর প্রতি অনুরাগী হয়েছেন এবং আল-আমীনও তার আচরণে মুগ্ধ। আর আপনারা আমাদের উভয় পক্ষের বংশানুক্রমিক যোগসূত্র সম্বন্ধেও ওয়াকেবহাল রয়েছেন। সুতরাং আজ এই শুভলগ্নে আমি আমার পক্ষ হতে পাঁচশো দেরহাম দেনমোহর আদায় করে উভয়কে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করলাম।
প্রতু্যত্তরে ওয়ারাকা-বিন নওফেল স্বীয় ভাষণে বললেন-সকল প্রশংসা আলস্নাহরই নিমিত্ত যিনি আপনাদেরকে সমগ্র আরবের নেতা হিসেবে মর্যাদা দান করেছেন। সুধীমন্ডলী! আপনার শরাফতী ও আভিজাত্য সর্বজনস্বীকৃত ও চিরভাস্বর। আপনাদের সুমহান খান্দানের সঙ্গে নতুন করে আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপনে আমরা আগ্রহী। অতএব, হে সমবেত কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ! আপনারা সকলেই সাক্ষী থাকুন, আমি আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী খোয়াইলিদ কন্যা খাদিজাকে (রা.) মহামহিম আবদুলস্নাহ তনয় আল-আমীন মুহাম্মদের (স.) সঙ্গে পাঁচশো দেরহাম দেনমোহরে বিবাহ দিচ্ছি।
স্মর্তব্য যে, এই বিবাহ ইসলাম-পূর্ব আরবের রেওয়াজ অনুযায়ী হয়েছিল।
ডা. মাহযাবিন রহমান শাওলী
Post a Comment