পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সমঝোতা, মৈত্রীবন্ধনে উদারতা এবং শত্রুর প্রতি ক্ষমাসুন্দর মনোভাব পোষণ ছিল রসূলে করীম (স.)-এর পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। চরম শত্রুর প্রতিও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বন্ধুত্বপূর্ণ ঔদার্য প্রদর্শন করা ছিল তাঁর নীতি। মক্কা-বিজয়ের পর মক্কাবাসীদেরকে নিঃশর্তে ক্ষমা করে এবং তায়েফের অত্যাচারী সম্প্রদায়কে ক্ষমা ও তাদের জন্য আলস্নাহর দরবারে রহমত কামনার মাধ্যমে তিনি অনুপম কূটনৈতিক মহানুভবতার পরিচয় দেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মক্কাবাসীদের বহু শর্তকে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে এবং সেই চুক্তির প্রতি অবিচল থেকে কূটনৈতিক দ্ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। শুধু হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি নয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সম্পাদিত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক কিংবা ত্রিপাক্ষিক চুক্তিসমূহের শর্ত প্রতিপালনে তিনি যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন। নিরক্ষর নবী (স.)-এর পক্ষে লিখিত এইসব চুক্তিপত্র ও দলিলের আক্ষরিক বিধানের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা প্রদর্শন এক বিস্ময়কর ব্যাপার বৈকি।
ইসলামের আদর্শ প্রচার, নবীন মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বিকাশকে নির্বিঘ্ন করা এবং সম্প্রদায় তথা জাতিসমূহের মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবেশী এবং অদূরবর্তী রাজদরবারে রসূলে করীম (স.) দূত প্রেরণ করেন। দূতের মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্য ও এর অন্তর্নিহিত সত্যের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে পত্র প্রেরণ করতেন তা অধ্যয়ন করলে তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। দূত প্রেরণ এবং দূত গ্রহণের সময় তিনি সংশিস্নষ্ট দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং আচার- অনুষ্ঠান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং তার মেজাজ ধরে রাখার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতেন। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, পারস্পরিক সমঝোতা-তা হযরতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রোজ্জ্বল। দূত গ্রহণের সময় তিনি তাদের প্রতি তাঁদের দেশ, সরকার ও জনগণের প্রতি তাঁর অবিচল সৌহার্দ্যের কথা ব্যক্ত করতেন। বিদায়ের সময় তিনি দূতদেরকে সৌজন্যমূলক উপঢৌকন দিতেন। এর ফলে ইসলামের সৌজন্যবোধের নীতি উচ্চ প্রশংসিত হতো আর তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হতো আরো উৎসাহব্যঞ্জক। নাজ্জাশীর দরবারে একবার প্রেরিত হয়েছিলেন মুহাজির নেতা জাফর বিন আবু তালেব। নাজ্জাশীর সাথে খ্রীস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যকার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে যুক্তিবাদী আলোচনায় তাঁকে অংশগ্রহণ করতে হয়। আলোচনা শেষে জাফর নাজ্জাশীর দরবারে যে বিবৃতি দেন তা এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। বিবৃতিটির আংশিক উদ্ধৃতি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
"হে বাদশাহ্! আরবের অন্ধকার যুগে (আইয়ামে জাহিলিয়া) আমরা এমন এক জাতি ছিলাম-যারা অজ্ঞানতার অতলে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ছিলাম, মূর্তিপূজায় ব্যাপৃত থাকতাম, হারাম খাদ্য ভক্ষণ করতাম, গর্হিত ও লজ্জাজনক কাজ করতাম, নিজ বংশের অতি নিকটতম আত্মীয়কে হত্যা করতাম, প্রতিবেশীদের দাবি-দাওয়া এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতাম-এ অবস্থা অব্যাহত অপ্রতিহতভাবে চলতে লাগলঃ অতঃপর আলস্নাহ আমাদের মধ্য হতে আমাদের জন্য একজন নবী পাঠালেন-যাঁর বংশমর্যাদা, সততা, বিশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা এবং চারিত্রিক পবিত্রতা ও মহান গুণাবলি সর্বজনবিদিত। তিনি আলস্নাহ্র একত্বে (তাওহিদে) আস্থা জ্ঞাপন এবং আলস্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ ও তাঁর ইবাদত করার জন্যে আমাদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানালেন। ঃ তিনি আমাদের সত্য কথা বলতে, বিশ্বস্ত হতে এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের কর্তব্য যথার্থভাবে পালন করতে বলেছেনঃ আমরা তাই একমাত্র আলস্নাহ্রই উপাসনা করি এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করি না এবং আমাদের জন্য অনুমোদন (জায়েয বা হালাল) করা হয়েছে, আমরা তা পালন করছি। এই সত্য পথ অনুসরণের ফলে আমাদের দেশের অনেক লোক আমাদের শত্রু হলো এবং আমাদের ওপর নিপীড়ন চালাতে লাগল; তারা আমাদের এই মহান ধর্মের পথ বিচু্যত করে পুনরায় আমাদের পৌত্তলিকতার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করতে লাগল। বাদশাহ নাজ্জাশীর সঙ্গে আলোচনায় হযরত জাফর আল-কুরআনের সমর্থন পেশ করেন (আল-কুরআন ১৯:১৬-৩৪)। ফলে নাজ্জাশী মুসলমানদের রক্ষণাবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। মুহাজিরদের বিরুদ্ধে প্রেরিত কুরাইশ প্রতিনিধিদের দাবি-দাওয়ায় তিনি কোনোরূপ কর্ণপাত করলেন না।
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Post a Comment