السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

ইসলামে প্রতিবন্ধীদের অধিকার

| comments

ইসলাম প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাধারণত প্রতিবন্ধী বলতে স্বাভাবিক কর্ম সম্পাদনে অক্ষম ব্যক্তিকে বোঝায়। প্রতিবন্ধী মূলত শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণেন্দ্রিয়র ক্ষতির কারণে হয়ে থাকে। তাদেরও মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্য-সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বঞ্চিতদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর তাদের (বিত্তবান) ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা আল-যারিয়াত, আয়াত-১৯)

একজন প্রতিবন্ধী সমাজে সুস্থ-সুন্দরভাবে বিকশিত হয়, যদি দেশের অবকাঠামো ভালো হয়। মানবাধিকার, উপযুক্ত পরিচর্যা, অনুকূল পরিবেশ, আর্থিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনা পেলে তারা দেশ ও জাতি গঠনে যোগ্য অংশীদার হতে পারে। প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থসামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। প্রতিবন্ধীর প্রতি দয়া-মায়া, সেবা-যত্ন, সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহূদয়তার হাত সম্প্র্রসারণ করা ইসলাম অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্য প্রাপ্য। মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। তাই একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অবশ্যকরণীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি)

শারীরিক, শ্রবণ, বাক, বুদ্ধি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একটি অংশ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। অপর অংশ দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়। জন্মপ্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো, যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১-৩) গর্ভাবস্থায় মায়ের দৈহিক কোনো ঘাটতি, পুষ্টিহীনতা বা অসুস্থতা, জন্মের পর বেড়ে ওঠার সময় অপুষ্টি, রোগাক্রান্ত হওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতিসহ পিতা-মাতার অমনোযোগ ও অযত্নের কারণেও শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৬)

জন্মপ্রতিবন্ধীই হোক আর দুর্ঘটনাজনিত প্রতিবন্ধীই হোক, ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা, সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং অন্যদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। বিপদ-আপদে সব সময় প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবি ও ঈমানি দায়িত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে অসদাচরণ বা তাদের উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা সৃষ্টিকে তথা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল। প্রতিবন্ধীদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করতে পারেন সেসব ধর্মপ্রাণ সংবেদনশীল মানুষ, যাঁরা অপরের দুঃখ-বেদনাকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেন।

একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ নেতাদের সঙ্গে আলোচনারত ছিলেন। এমতাবস্থায় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাক্তুম (রা.) নামের এক অন্ধ সাহাবি সেখানে উপস্থিত হয়ে মহানবী (সা.)-কে দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এতে কুরাইশদের সঙ্গে নবীজির আলোচনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন। নবী করিম (সা.) মক্কার জাত্যভিমানী কুরাইশদের মন রক্ষার্থে প্রতিবন্ধী লোকটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কিন্তু আল্লাহর কাছে এ বিষয়টি পছন্দনীয় হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে আয়াত নাজিল হয়; যাতে তাদের প্রতি ইসলামের কোমল মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার কাছে অন্ধ লোকটি এল। তুমি কেমন করে জানবে—সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত।’ (সূরা আবাসা, আয়াত: ১-৪)

নবী করিম (সা.) প্রতিবন্ধীদের সর্বদাই অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাক্তুম (রা.)-কে নবীজি তাঁর অপার স্নেহে ধন্য করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখনই তাঁকে দেখতেন, তখনই বলতেন, ‘স্বাগতম জানাই তাঁকে, যাঁর সম্বন্ধে আমার প্রতিপালক আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন।’ মহানবী (সা.) এ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবিকে দুবার মদিনার সাময়িক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এ জন্য প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসা নবী করিম (সা.)-এর অনুপম সুন্নতও বটে। ঘটনাক্রমে রাসুলে করিম (সা.) যদি প্রতিবন্ধীকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় সতর্কীকরণের মুখে পড়তে পারেন, তাহলে ধর্মপ্রাণ মানুষ এ কাজ করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং সবাইকে খুব সতর্ক হতে হবে এবং প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা নয়, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে সবারই প্রতিবন্ধীদের অধিকারের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের বৈষম্য ও দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। ইসলাম শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে দুর্বল-অসহায় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবন্ধীরাও তাদের পিতা-মাতার প্রিয় সন্তান। তাদের মধ্যেও সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, স্নেহ-ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের অনুভূতি আছে। এ জন্য দেশ গড়ার ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামের আলোকে প্রতিবন্ধীদের পরমুখাপেক্ষিতার পথ থেকে স্বাবলম্বিতার পথে আনতে হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ (মুসলিম)

মানবসমাজে যারা প্রতিবন্ধী, তারা সমাজের বোঝা নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে অনেকে আল্লাহ প্রদত্ত তীক্ষ মেধাসম্পন্ন অনন্য প্রতিভা। শারীরিক বা যেকোনো প্রতিবন্ধিতা অক্ষমতা নয়, বরং ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। দুস্থ প্রতিবন্ধী ও পঙ্গু-বিকলাঙ্গদের সেলাইয়ের কাজ, কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, কাঠশিল্প, মৃৎশিল্প, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, সংগীত প্রভৃতি সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন যোগ্যতার মাধ্যমে দক্ষতা গড়ে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। আমাদের সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রতিবন্ধীদের উপেক্ষা করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনো সম্ভব হতে পারে না। সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশ অসহায় প্রতিবন্ধীদের ইসলাম প্রদত্ত অধিকার সুরক্ষা হচ্ছে কি না, তা সবারই লক্ষ করা উচিত।

-ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template