একজন বিখ্যাত জার্মান লেখক বলেছেন, "মানব জাতির ইতিহাসে ইসলাম যেরূপ দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্বমানবের হূদয় স্পর্শ করে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। হযরত মহাম্মদ (স.) তাঁর সমকালীন সময়েও তিনি যেরূপ জাতির প্রিয়তর হয়েছিলেন, জগতের জন্য কোনো ধর্ম প্রবর্তক অনুরূপ হতে পারেননি।" তিনি সমগ্র আরব জাতিকে অজ্ঞতার অন্ধকার হতে উদ্ধার করে সুসভ্য ও আলোকময় জাতিতে পরিণত করেছিলেন। পরে এই জাতি পাঁচ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান, বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায় জগতের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভারত উপমহাদেশ, আফগানিস্তান, তুরস্ক, আরব দেশসমূহ, আফ্রিকা এবং ইউরোপের দেশসমূহে ও মুহাম্মদ (স.) -এর অনুসারীদের নেতৃত্বে আসে। অথচ অতীতের সভ্যতা গর্বিত গ্রীক, রোমান প্রভৃতি জাতি এত অল্প সময়ে সারাবিশ্বে বিস্তৃত হতে পারেনি। কারণ মুসলমানদের জ্ঞান-অন্বেষণ ছিলো জগতের ইতিহাসে নজীরবিহীন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকেই মুসলমানগণ আরব এবং বিজিত অঞ্চলে জ্ঞান-বিস্তারের জন্য বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। কায়রো, বাগদাদ এবং কর্দোভা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম। অথচ গ্রীক, রোমান জাতি তা কল্পনাই করতে পারেননি।
মুসলমানরা কুতুবখানা, বড় বড় লাইব্রেরী নির্মাণ করেন। এসব লাইব্রেরীতে অসংখ্য মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহ করা হতো। আর মুসলমানরা গ্রীক বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এবং তাদের গ্রন্থ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত ছিলেন। অ্যারিস্টটল, পেস্নটো, সক্রেটিস, থিওফাসটাস, পিথাগোরাস, টলেমি প্রমুখ বিজ্ঞানীদের পুস্তক তারা আরবীতে অনুবাদ করেন। বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে মুসলমান বিজ্ঞানীরা অনেক মৌলিক তত্ত্ব অবদান রাখেন। শূন্য (ুবৎড়) এই উপাত্তটি আরব পন্ডিতদের আবিষ্কার। এটা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা কতর্ৃক আবিষ্কৃত হয়। তিনি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দশমিক বিন্দুর ব্যবহার এবং সংখ্যার স্থানীয় মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। আরব বিজ্ঞানীরা ইউক্লিডের জ্যামিতির বিশেষ উন্নতি সাধন করেন। আধুনিক গণিতশাস্ত্রের অন্যতম বহুল ব্যবহার বীজগণিত তাদেরই আবিষ্কার। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল-জাবিরের নামানুসারে অ্যালজেব্রার নামকরণ হয়। মুসা আল খারেজমী কতর্ৃক ত্রিকোণমিতির আবিষ্কার হয়। আরব বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখেন। আল-হাজন কতর্ৃক ফোকাস নির্ণয়, চামশার আবিষ্কার হয়।
তাদের বহু গ্রন্থ ল্যাটিন, ইতালী, জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানরা যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তারাই পৃথিবীর প্রথম মান-মন্দির নির্মাণ করেন। আল-ফারগানী, আল-বাত্তানী ছিলেন সমকালীন সময়ের পৃথিবীর অন্যতম জ্যোতির্বিদ। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা আরবদেরই অবদানে সৃষ্টি। আরবেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা দেন। ইবনে সীনা যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক তা পাশ্চাত্য মনীষীরাও অকপটে স্বীকার করেন। রসায়নশাস্ত্রেও আরবদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। জাবির ইবনে হাইয়ান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ। সাহিত্যক্ষেত্রেও আরবদের অবদান অপরিসীম। কাব্যে তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। ভূগোলবিদ্যায়ও মুসলমানরা প্রভূত অবদান রেখেছেন। দিক-দর্শন যন্ত্র তাঁদেরই আবিষ্কার। স্থাপত্য নকশায় ছিলেন আরবেরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মোটকথা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আথিতেয়তা, ন্যায়বিচার প্রভৃতির জন্যে মুসলমানদের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সুতরাং বিশ্বসভ্যতা বিকাশে ইসলামের দান অনস্বীকার্য।
শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
Post a Comment