প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ঐতিহাসিক কারবালা যুদ্ধের হূদয়বিদারক মর্মন্তদ ঘটনা বিজড়িত আশুরা দিবস আমাদের মাঝে 'ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাই না' এর বারতা নিয়ে যথারীতি হাজির হয়েছে। এই দিনে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) এর পরিবারের সতের জন শিশু-কিশোর যুবকসহ মোট ৭৭ জন মর্দে মুজাহিদ কারবালার প্রান্তরে ফোয়াতের দুই কূল ছাপা নদীর কিনারায় এক বিন্দু পানি হতে বঞ্চিত হয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। হযরত রাসুল (সঃ)-এর দৌহিত্র হুসাইন (রাঃ)-এর পবিত্র মস্তক নিষ্ঠুর নরাধম শিমার ছিন্ন করে কুফার দুরাচার ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের দরবারে প্রেরণ করেছিল। কেন এ মহান ত্যাগ ও শাহাদাত? এটা কি ছিল এজিদের হাত থেকে খেলাফত কেড়ে নেয়ার জন্যে? তা নয়। হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর শিবিরে মাত্র ৪০ জন লোক ছিল তরবারী চালানোর মত। পক্ষান্তরে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর চার হাজার রণ নিপুণ সৈন্য পাঠিয়েছিল। এ অসম যুদ্ধে পরাজয় ও মৃতু্য ছিল নিশ্চিত। তারপরও কেন স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ? কারণ, শর্ত ছিল, 'হয় এজিদের আনুগত্য স্বীকার কর, না হয় যুদ্ধ কর'। রাসুল (সঃ)-এর কলিজার টুকরাসম হুসাইন (রাঃ) একটি মুহূর্তের জন্য ও এজিদের আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামী খেলাফতের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চাননি। এমতাবস্থায় উম্মাহর মধ্যে শান্তি-শৃংখলা স্থাপনের জন্য একটি লিখিত চুক্তি হয়। যেখানে বলা হয়, হযরত মুয়াবিয়ার পর হযরত হুসাইন (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু মুয়াবিয়া তাঁর খেলাফত পরিচালনার শেষ সময়ে স্বীয় পুত্র এজিদকে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাব দেন। তখন সমস্যা সৃষ্টি হন। এজিদ জনমতের কোন তোয়াক্কা না করে নিজেই খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়। তখন সর্বত্র বিশৃংখলা দেখা দেয়।
ইসলামী খেলাফতের মর্যাদাকে ধ্বংস করে রাজতন্ত্রের সূত্রপাতকে বেশিরভাগ মুসলমানেরা সে সময় মানতে পারেননি। যার কারণে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে এজিদের বিরুদ্ধে। এজিদ তখন তার বিষদাঁত প্রক্ষালন করল। সে ভাবল, চারদিকের বিদ্রোহ দমন করার চেয়ে বরং হুসাইনকে (রাঃ) যদি দুনিয়া হতে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সব মামলা চুকে যায়। সাথে সাথে নিজের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ইসলামী খেলাফতে কলঙ্ক সৃষ্টিকারী এজিদ সেই হুসাইনকে (রাঃ) হত্যা করার পরিকল্পনা করল যিনি বেহেশতের সব যুবকদের সরদার হবেন। এই কথা রসুল (সাঃ) বলেছিলেন, 'হাসান-হুসাইন হবে বেহেশতের সব যুবকদের সরদার' তখন থেকে রাসুলের সাহাবীরা তাদেরকে আরো বেশি বেশি মহব্বত করার, খুশি করার চেষ্টা করতেন। তাঁরা কষ্ট পান এমন কোন কাজ কেউ করতেন না। একটি দৃষ্টান্ত দিলে সহজেই বিষয়টি অাঁচ করতে পারবেন। হযরত রাসূল (সাঃ)-এর একজন সাহাবী ছিলেন তার নাম দাহিয়া কলবী (রাঃ)। তিনি হযরত হাসান হোসাইনকে (রাঃ) খুব ভালবাসতেন। তাদেরকে খুশি করার জন্য অনেক দূর-দুরান্ত থেকে ফলফলারী নিয়ে আসতেন পকেট ভর্তি করে। যখন হযরত হাসান-হুসাইন (রাঃ) দেখতেন যে, দাহিয়া কলবী (রাঃ)-এর আসছেন তখন তারা দৌড় দিতেন। এক দৌড়ে দাহিয়া কলবী (রাঃ) কাছে পেঁৗছাতেন। তাকে জড়িয়ে ধরতেন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতেন। আর ফল বের করে খেতেন। একদিন এই দৃশ্য আসমান থেকে হযরত জিব্রাইল (আঃ) দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলেন। তিনি ভাবলেন, যদি জিব্রাইল না হয়ে তিনি দাহিয়া হতেন। আর হযরত হাসান-হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে আসতেন। তাঁরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন তাহলে তাঁর জীবনটা ধন্য হয়ে যেত। সত্যিই একদিন চলে এলেন দুনিয়ায় হাসান-হুসাইনের কাছে দাহিয়া কলবী সাহাবীর রূপ ধারণ করে। যখন হাসান হুসাইন (রাঃ) দেখলো যে দূর হতে দাহিয়া কলবী সাহাবী আসছেন। তথন তাঁরা এক দেঁৗড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অন্যান্য দিনের মত পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমাকে তো দাহিয়া কলবীর মত দেখা যায়? কিন্তু তুমি বোধহয় দাহিয়া কলবী নও, কারণ তুমি যদি সত্যিই দাহিয়া কলবী হতে তাহলে তোমার পকেট কোনদিনও ফলশূন্য হতো না। জিব্রাইল (আঃ) লজ্জায় পড়লেন। বললেন, ওগো হাসান-হুসাইন! সত্যিই আমি দাহিয়া কলবী নই। আমি জিব্রাইল (আঃ)। তোমাদের নিকট থেকে একটু আদর নেয়ার জন্য আমি দাহিয়া কলবীর রূপ ধারণ করে এসেছি। কিন্তু দাহিয়া কলবীর রূপ ধারণ করে আসতে হলে যে ফল নিয়ে আসতে হয় এটা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সুতরাং সবাই চাইতো হাসান-হুসাইনকে খুশি করতে। তারা দুঃখ, কষ্ট পাবেন এমন কোন কাজ কেউ করতেন না। আমরা জানি হযরত বেলাল (রাঃ) যে জীবনের শেষ আজান দিতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন সেটাও ছিল হযরত হাসান হুসাইনের অনুরোধের কারণে। ঘটনা ছিল এমন, রসুল (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত বেলাল (রাঃ) মদীনার পথে-প্রান্তরে হাঁটতেন আর হা-হুতাশ ও আক্ষেপ করতেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মদীনায় রসুল নেই সেখানে আমি বেলাল থাকতে পারব না। চলে গিয়েছিলেন সিরিয়ার দামেস্কে। দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে সমসাময়িক সাহাবিরা ও মুসলমানেরা হযরত ওমরকে অনুরোধ করেন বেলালকে মদীনায় নিয়ে আসার জন্য। হযরত ওমর (রাঃ) তখন বেলালের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন, 'বেলাল! তোমাকে একনজর দেখার জন্য মদীনার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। একটিবারের জন্য হলেও তুমি মদীনায় এসে দেখা দিয়ে যাও।
হযরত বেলাল (রাঃ) আমীরুল মোমেনীনের চিঠির অবমাননা হবে ভেবে মদীনায় এসেছিলেন। তখন মদীনার সকল মানুষেরা তাঁকে একনজর দেখার জন্য পঙ্গপালের মত দূর-দূরান্ত হতে ছুটে এসেছিলেন। আর দাবি করেছিলেন, একটিবার বেলালের সেই সমুধুর আযান শোনার জন্য। কিন্তু হযরত বেলাল (রাঃ) তখন বলেছিলেন, ওগো সাহাবীরা যেখানে রাসূল নাই সেখানে আমি কিভাবে আজান দিব? রসুলবিহীন বেলাল কোনদিনও আজান দিতে পারে না। সব সাহাবীর অনুরাধ রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু সবশেষে যখন হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন (রাঃ) অনুরোধ করেছিলেন, তখন বেলাল ভাবলেন, তাদের অনুরোধ না রাখলে তারা কষ্ট পাবেন। এটা বেলালের কাছে আরো বেদনাদায়ক। তাই তিনি মিনারে উঠে যখন আজান দিচ্ছিলেন। যখন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুলস্নাহ (সঃ) বললেন, তখন পূর্বের মত শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে রাসুলের রিসালাতের সাক্ষ্য দেয়ার সময় দেখেন রসুল (সঃ) মেম্বারে নাই। শূন্য মেম্বার নিরব নিস্তব্ধ পড়ে আছে। এই শূন্যতা হযরত বেলালকে তোলপাড় করে ফেললো। বুকের ভিতরে বিকট জোরে একটি ঝাঁকুনি দিল। তিনি মিনার হতে পড়ে গেলেন। আর আলস্নাহ তাকে শাহাদাতের মৃতু্য দিয়ে তার দরবারে উঠিয়ে নিলেন। কেবল দাহিয়া কলবী ও বেলাল (রাঃ) নন, স্বয়ং রাসুল (সঃ)ও হাসান-হুসাইনকে খুশি করতেন। তাঁরা কষ্ট পান এমন কাজ কখনোই করতেন না। একদা জামায়াতে নামাজ পড়ানোর সময় একটি সিজদা অস্বাভাবিক লম্বা হলো। নামাজ শেষে একজন সাহাবী এর রহস্য জানতে চাইলেন। মহানবী (সঃ) বললেন, হাসান-হুসাইন আমার পীঠে চড়েছিল। আমি তাদের নামিয়ে দেয়াকে পছন্দ করেনি। অন্য বর্ণনায় আছে, মেম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা দেয়ার সময়ও হাসান-হুসাইন আসলে তাদের দুই ভাইকে দুই কোলে নিতেন এবং খুৎবা চালিয়ে যেতেন। যে হাসান-হুসাইনকে সবাই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেন। তাদের একজন অর্থাৎ হুসাইনকে (রাঃ) কেবলমাত্র কষ্ট নয় তাকে শহীদ করে দেয়ার জন্য এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের সৈন্যরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। সেদিন ছিল ১০ই মহররম ৬১ হিজরী।
প্রবল বীরবিক্রমে মুসলিম সৈনিকেরা শাহাদাতের পেয়ালা হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় দুই হাজার শত্রু সৈন্য খতম করে দিলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী হতেও ঝরে পড়ল অনেকগুলো তরতাজা প্রাণ। ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের বা এজিদের বাহিনী পানির দখল নিয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুসাইন শিবিরে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেল। কাসেমকে কোলে নিয়ে শত্রুদের কাছে এক কাতরা পানি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু পুত্র আলী আকবর ও কাসেমের মৃতু্য হযরত হুসাইনকে আবারো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করলো। তিনি অনেক শত্রু নিধন করলেন। অবশেষে একটি তীর এসে তার গণ্ড মোবারক অবধি বিদ্ধ হলো। সাথে সাথে ঘোড়ার পৃষ্ঠ হতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। একটানে তীরটি বের করে ফেললেন ও শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকলেন। কিন্তু গণ্ডদেশ হতে রক্তক্ষরণ তাঁকে দুর্বল করে ফেলল। এমতাবাস্থায় পর পর কয়েকটি তীরবিদ্ধ হলেন হুসাইন (রাঃ)। অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কাফেররা তাঁর মস্তক কাটার জন্য ইতস্তত করতেছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর পাষণ্ড নরখাদক শিমার হযরত হুসাইন (রাঃ)এর মস্তক কর্তন করে তা নিয়ে এজিদের দরবারে পেঁৗছালো। এই যুদ্ধে হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর পুত্র জয়নাল আবেদীন ছাড়া সবাই শাহাদাতবরণ করেন। এই দিনে রক্ত প্রবাহিত না করে ইবাদত বন্দেহী ও আশুরার ২টি রোজা অর্থাৎ মহররমের (৯, ১০/১০, ১১ তারিখের) রোজা আদায়ের মাধ্যমে আলস্নাহর সন্তুষ্টি ও আদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
Post a Comment