হজ্বের প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমনই এক মহাসম্মেলন যেখানে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন। সকলেরই লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জেয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটিমাত্র কথা- লব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! হজ্বের এ সফরে অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়, কোনও লক্ষ্য নয়, কোনও পার্থিব স্বার্থের আকর্ষণ নয়, শুধুমাত্র আলস্নাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হূদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের এক শুচিশুদ্ধ ফল্গ-ধারা।
দ্বিতীয়ত হজ্বের এ মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানব জাতির প্রথম আবাসস্থল। উম্মুলকোরা মক্কানগরীতেই যে আদি মানব হযরত আদম (আ.) প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ তথ্য সন্দেহাতীত। সে আদি বসতির মধ্যেই এক আলস্নাহর এবাদত আরাধনার লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম গৃহ পবিত্র বায়তুল্লাহ, এ তথ্যও পবিত্র-কোরআনে পরিবেশিত হয়েছে। বর্ণিত আছে হযরত আদম উম্মুলকোরা পবিত্র মক্কায় স্থিত হওয়ার পর মুনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন, ঊধর্্ব জগতে ফেরেশতাগণের উপাসনাস্থল বায়তুল মামুরের অনুরূপ একখানা উপাসনালয় পাওয়ার জন্য। আলস্নাহর সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেই ফেরেশতা জিব্রাঈলের মারফতে বায়তুল মামুরের সঠিক বরাবরেই মাটির ওপর পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের স্থান নির্দেশ করেন। এ ঘরের যে চৌহদ্দিটুকু হরম বা পবিত্রতার সীমারেখায় চিহ্নিত সেটুকুও ফেরেশতার মাধ্যমেই আলস্নাহপাক দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সে প্রথম গৃহে, মানব সন্তানের জন্যে সৃষ্ট প্রথম এবাদতগাহ বা উপাসনালয়ে আদি মানবের বাৎসরিক এ মহাসমাবেশে যে আবেগময় অনুভূতি সৃষ্টি করে সে অনুভূতি সমগ্র বিশ্ব মানব তথা আদি সন্তানের একই রক্তের উত্তরাধিকার এবং আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনকেই নবায়িত করার অনুভূতি। পবিত্র ক্বোরআনে বর্ণিত আছে, আমাদের আদি পিতা-মাতা প্রথম সেখানে সেজদা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভুর উদ্দেশ্যে। তাঁর এবাদতের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছিল সে ঘরটি। সুতরাং সে ঘরের প্রতি একটা আবেগপূর্ণ আকর্ষণ এক আলস্নাহতে বিশ্বাসী প্রতিটি মানব সন্তানের মন মস্তিষ্ক সুপ্ত হয়ে থাকাটা নিতান্তই স্বাভাবিক।
বিশ্ব মানবের শান্তি ও সৌহার্দ্যের পথে সর্বাপেক্ষা বড় অন্তরায় হচ্ছে গৌত্র, বর্ণ, ভাষা এবং ভৌগোলিক সীমারেখার স্বার্থ চিন্তা। একের ওপর অন্যের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার একটা প্রাণান্তকর সাধনা সর্বত্রই অত্যন্ত প্রকট। মানুষের অন্তরে তার জন্মগত ঐক্যের অনুভূতি দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক কতগুলো প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক করে দেয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সমবেত হওয়া, সপ্তাহে একদিন অপেক্ষাকৃত আর একটু বড় সমাবেশ জুমআয় একত্রিত হওয়া এবং বছরে দু'বার বৃহত্তম সমাবেশ সে ধরনেরই একটা বিশ্ব সম্মেলন। এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য সমগ্র আদম সন্তানের জন্মগত অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের অনুভূতি তীব্রতর করে সকল শ্রেণীর মানুষকে একই সারিতে এক জামাআতে দাঁড় করাতে। তাই বিশ্বজনীন এ অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাই হচ্ছে হজ্বের সর্বপ্রধান শিক্ষা।
- আফতাব চৌধুরী
Post a Comment