মাহমুদ আহমদ
শিয়া মত ইসলাম থেকে ভিন্ন কোনো দ্বীন নয়। এর ভিত্তি কোরআন, হাদিস ও আহলে বায়তের শিক্ষাদীক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত। শিয়া মতের বিস্তৃতি ও গৌরবকালে উমাইয়া শাসকদের জুলুম-নিপীড়ন, বিশেষ করে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রোশ, ক্ষোভ ও আহলে বায়তের প্রতি জনগণের সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই মতাদর্শের মাধ্যমে। এই সমবেদনাকে পুঁজি করে বনু আব্বাস উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। তারা রাসুল পরিবারের ঘোষণা দিয়ে তাদের অভ্যুত্থানকে সফল করে তোলে। এসব যদিও হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, কিন্তু এর দ্বারা হজরত রাসুলে করিম (সা.)-এর পরিবারের প্রতি সাধারণের ভালোবাসার পরিমাণও বেড়েছে বলে ধারণা করা যায়।
হিজরি ১৩৩ সালে উমাইয়া শাসনের পতন হয় এবং আবুল আব্বাস আস্ সাফ্ফাহ খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হন। উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের দুই শাসনের মধ্যবর্তী সময়ে ইমাম জাফর আস-সাদিক স্বাধীনভাবে ইল্ম ও মারিফাত ও মাজহাবের বিস্তৃতির সুযোগ পেয়ে যান। তাঁর পশ্চাতে ধনদৌলত তথা বস্তুগত শক্তি কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কোনোটাই ছিল না, কিন্তু এটা ছিল ইমামের ইলমি ও আমলি শক্তি এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাব। ফলে লোকজন বিভিন্ন স্থান থেকে আকৃষ্ট হয়ে আসতে থাকে ইমামের সানি্নধ্য লাভে ধন্য হতে। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর পাঠচক্রে চার হাজার ছাত্র জড়ো হয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.), সুফয়ান ইবনে উয়ায়না (রহ.), সুফয়ান ছাওরি (রহ.), শুবা ইবনে হাজ্জাজ (রহ.) ও ফুদায়ল ইবনে আয়াদের মতো ফকিহ ও মুহাদ্দিসরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ফলে গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলনের কাজ বিস্তৃতি লাভ করে। প্রসিদ্ধ ৪০০ গ্রন্থ, যাকে শিয়া পরিভাষায় উসুলে আরবাআ মিয়া বলা হয়, এর অধিকাংশই এ সময়ে লিপিবদ্ধ হয়। শিয়া মুহাদ্দিসরা এই ৪০০ গ্রন্থকে উৎস ধরে হাদিসের এক বিশাল সংকলন তৈরি করে সর্বকালের জন্য সংরক্ষণ করে রাখেন। আব্বাসি শাসকদের রাজধানী ছিল ইরাকের বাগদাদে। হজরত আলী (রা.)-এর রাজধানীও ছিল এই ইরাকের কুফায় (নজফ)। ফলে আগে থেকেই এখানে শিয়াদেরও ছিল শক্ত ঘাঁটি। আব্বাসিদের শত্রুতামূলক আচরণ সত্ত্বেও শিয়াদের প্রভাব ক্রমে বাড়তে থাকে, এমনকি রাজধানী বাগদাদেও শিয়া মত সর্বদা বিদ্যমান থাকে। 'কোখ' নামক বাগদাদের একটি মহল্লায় শুধু শিয়াদের বসতি ছিল। এখানে বহুসংখ্যক আলিম ও ফকিহ ছিলেন। তাঁরা গ্রন্থ রচনা ও সংকলন করা ছাড়াও শিক্ষাদানের কাজ চালাতেন। তাঁদের মধ্যে আবু আবদিল্লাহ শায়খ মুফিদ, শায়খ আবু জাফর তুসি, সায়্যিদ মুরতাদা উলুমুল হুদা, সায়্যিদ রাদি (নাহজুল বালাগার লেখক) এবং আরো বড় বড় আলেম তখন বাগদাদেই বসবাস করতেন। পরে অবশ্য স্থানীয় গোলযোগ ও ফিতনার কারণে বাগদাদের শান্তি ও নিরাপত্তা তিরোহিত হলে শায়খ আবু জাফর তুসি ৪৪৮ হিজরিতে বাগদাদ ত্যাগ করে নাজাফ চলে আসেন। তাঁরই শিক্ষাদীক্ষায় নাজাফও শিক্ষাদীক্ষার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়। বর্তমানেও নাজাফ বিশ্বের শিয়া সমপ্রদায়ের সর্বাপেক্ষা বড় শিক্ষাকেন্দ্র।
ইরানে শিয়া মতের প্রসার প্রথম দিকে অত্যন্ত ধীর গতিতে চলে। কেবল কুম্ম নগরীতেই কিছু শিয়া ছিল। মূলে তারা ছিল আরব। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারা কুফা থেকে কুম্মে চলে আসে এবং শিয়া মত ধারণ করেই আসে। তাদের প্রচারণায় কুম্মবাসী শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করে। মামুনুর রশীদের খিলাফতকালে ইমাম আলি রিদা (রহ.) খুরাসানে গেলে সেখানে শিয়া মত দ্রুত প্রসারিত হয়। হিজরি ৩২০ সালে দায়লামিরা ইরানের কয়েকটি শহর জয় করেন। ফলে তাঁরা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় খিলাফতের প্রধানমন্ত্রীর পদ পর্যন্ত অর্জন করেন। দায়লামিরা শিয়া মতে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁরা শিয়া উলামাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং শিয়া আকিদার প্রসারকাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এরপর শাহ ইসমাইল সাফাবির হাতে সাফাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়া মতের আরো প্রসার ঘটে।
সাফাবি শাসনের অবসান হলে জানদিয়া ও কাচারিয়া সুলতানরা শিয়া মতের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের সহযোগিতায় শিয়া মত আরো বিস্তার লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে ইরান শিয়াদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। কুম্ম, মাশহাদ, তেহরান, নিশাপুর, নিহাওয়ানদসহ বিভিন্ন শহরে শিয়াদের বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান আছে।
পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানে শিয়া মতবাদ ওইসব আলেম ও মুবালি্লগের সাহায্যে প্রসার লাভ করেছে, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশে আগমন করেন এবং এখানেই থেকে যান। ৬১৭ হিজরি যখন চেঙ্গিস খান ইরানের ওপর আক্রমণ চালান, তখন শিয়াদের একটা অংশ ভারতবর্ষে চলে আসে। হাসান গাংগু বাহমানি হিজরি ৭৪৮ সালে দাক্ষিণাত্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং বাহমানি রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। এদিকে ইয়ুসুফ আদিল শাহ ৮৯৫ হিজরি সালে বীজাপুরে নিজের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
সেই সময়েই শিয়াদের কিতাব প্রকাশের জন্য সরকারিভাবে প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বহু দ্বীনি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। শিয়া আলেমদের মধ্যে সায়্যিদ দিলদার আলী গুফরান মাআব ও তাঁর ছাত্র শাগরিদ বিশেষ আন্তরিকতার সঙ্গে সামাজিক কুপ্রথার সংস্কার, শিক্ষার সমপ্রসারণ ও ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সৌদি আরব, লেবানন, বৈরুত ও বালাবাকে যথেষ্ট শিয়া রয়েছে। জাবাল আমিলের শহর সায়দা ও সুরে শিয়াদেরশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে এবং প্রায় সব অধিবাসীই শিয়া। ইয়েমেনে জায়দি সমপ্রদায় ও শাফিয়ি মতাবলম্বী ছাড়াও বিপুলসংখ্যক শিয়া বসবাস করে। রাশিয়ার অধিকৃত শহর ইরওয়ানের সব অধিবাসী শিয়া। মায়ানমার, মালয় ও সিংগাপুরে বিপুলসংখ্যক শিয়া বসবাস করে। মোটকথা বিশ্বের যে যে ভূ-খণ্ডে মুসলমানরা বাস করছে, সেসব ভূ-খণ্ডে কম-বেশি শিয়ারাও ইসলামের একটি সমপ্রদায় হিসেবে রয়েছে।
Post a Comment