السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

শিয়া-সুনি্ন মতাদর্শ : শিয়া-সুন্নি উদ্ভবের ইতিহাস

| comments

শিয়া শব্দটির অর্থ গোষ্ঠী এবং এটা 'শিয়াত-ই-আলী'_অর্থাৎ আলীর গোষ্ঠী হতে গ্রহণ করা হয়েছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসলামে সর্বপ্রথম কোন্দল শুরু হয়। হজরত আবু বকর (রা.)-এর নির্বাচনের সময় কিছু ব্যক্তি হজরত আলী (রা.)-কে সমর্থন করেন। কারণ তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহর জামাতা এবং চাচাতো ভাই (আবু তালেবের পুত্র)।
সৈয়দ আমির আলীর 'দ্য স্পিরিট অব ইসলাম' পুস্তকে দেখা যায়, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর চাচা আব্বাস আবু তালেবের দুই পুত্রকে লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নেন আলীকে এবং আব্বাস নেন জাফরকে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনো পুত্র জীবিত না থাকায় শিশু আলীর ওপর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপত্য স্নেহ ঝরে পড়ে। এর এক বছর পরই (৬০৬ খ্রি.) ফাতেমা (রা.)-এর জন্ম হয়। হজর আলী (রা.) ফাতেমার সঙ্গে একই সংসারে বেড়ে ওঠেন এবং বদর যুদ্ধের কিছু দিন আগেই বাগদান হয়। এর তিন মাস পর তাঁদের বিবাহ হয়। এ সময় আলী (রা.)-এর বয়স ছিল ২১ আর ফাতেমা (রা.)-এর বয়স ১৫ বছর। (দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪ ও ৬৯)। এ জন্যই আলী (রা.)-কে একশ্রেণীর মানুষ রাসুলুল্লাহর পুত্রস্থানীয় মর্যাদা দিতেন।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচনকালে তাই একদল লোক হজরত আলী (রা.)-এর পক্ষ সমর্থন করেন। বিদ্যা-বুদ্ধি, শৌর্য-বীর্য এবং রাসুলের সঙ্গে আত্দিক সম্পর্কের জন্য তাঁরা হজরত আলী (রা.)-এর পক্ষাবলম্বন করেন। কিন্তু হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হলে হজরত আলী (রা.)-এর সমর্থকরা এটাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর হজরত ওমর (রা.) ও হজরত ওসমান (রা.)-এর খলিফা নির্বাচনেও এই দলের কোনো সমর্থন ছিল না।
তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) নিহত হওয়ার পর হজরত আলী (রা.) চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন। কিন্তু সিরিয়ার শাসনকর্তা মাবিয়া হজরত আলী (রা.)-এর বিরোধিতা করায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং সিফ্ফিনের যুদ্ধে হজরত আলী (রা.)-এর বিপর্যয় ও পরে একজন খারেজি কর্তৃক তিনি নিহত হওয়ায় শিয়া আন্দোলন জোরদার হয়। এর কয়েক বছর পর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক ইমাম হোসেনের নৃশংসভাবে মৃত্যু শিয়া আন্দোলনকে সুদূরপ্রসারী করে। এ সময় থেকেই শিয়া মতবাদের উদ্ভব হয় এবং রাজনৈতিকভাবে এই সম্প্রদায় আত্দপ্রকাশ করে।
উমাইয়া খিলাফতের আমলে (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) শিয়া সম্প্রদায় কারবালার নৃশংসতার প্রতিবাদে আল-মুখতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইরাক ও পারস্যে তাদের আধিপত্য দৃঢ় হয়। যাবের যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ, সীমার প্রভৃতি ইমাম হোসেনের হত্যাকারীদের হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়। পারস্য শিয়া মতাবলম্বীদের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। উমাইয়া শাসকদের নির্যাতনের ফলে পারস্যবাসী শিয়াগোষ্ঠীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। উমাইয়া বংশের পতনের জন্য শিয়াগোষ্ঠী আব্বাসীয়দের সঙ্গে মিলে বিদ্রোহ করে। আবু মুসলিমের ভূমিকা এতে প্রধান ছিল। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফারা শিয়াদের প্রতি মিত্রভাব বজায় রাখেননি। আল-মনসুর ইমাম হাসান ও হোসেনের বংশধরদের ওপর কঠোর উৎপীড়ন করেন। এ সময় ইদ্রিস নামে ইমাম হাসানের একজন বংশধর পালিয়ে যান এবং তানজিয়রে একটি রাজ্য কায়েম করেন। খলিফা আল-মামুন মুতাজিলা মতবাদ প্রসারের জন্য ইমাম আলী আর রেজার সঙ্গে সখ্য শুরু করেন এবং নিজ বোনের সঙ্গে ইমামের বিয়ে দেন। কিন্তু খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল মুতাজিলা মতবাদ রোধ করেন এবং অসংখ্য শিয়া নেতাকে হত্যা করেন। কিন্তু এতে শিয়ারা দমেনি। তানজিয়রে ইদ্রিসীয় বংশ ব্যতীত শিয়া সম্প্রদায় যেসব রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইয়েমেনের জায়েদি এবং আফ্রিকার ফাতেমি বংশ।
শিয়া মতবাদের তিন প্রধান রূপ দেখা যায় : (১) জায়দি, (২) মধ্যমপন্থী ও (৩) চরমপন্থী। জায়দিরা সুনি্নদের প্রায় নিকটবর্তী। তাঁরা ইমামের মধ্যে 'আল্লাহর অভিব্যক্তি'মূলক মতবাদের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেন এবং বলেন, এর অর্থ_আল্লাহ থেকে সত্যপথের নির্দেশ লাভ করা। তাঁরা আলী-বংশীয় ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাস করেন না। শাহাদত লাভ সম্বন্ধে কোনো ধর্মীয় রূপ দেন না, এটা রাজনীতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁরা মনে করেন, মানুষের তরবারির বলে ও আল্লাহর সাহায্যে আলী বংশীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইমাম মেহেদির আবির্ভাব সম্বন্ধে যে নানা ধরনের মতবাদ, তার নির্ধারণ যুক্তির সঙ্গে করেন। আর চরমপন্থীরা ইমামের মধ্যে ঐশ্বরিক সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে। এ অবস্থাকে 'হুলুল' বলা হয়। ইমামের লৌকিক সত্তা যখন বিলীন হয়, তখন তার কাছে আল্লাহরও কোনো স্থান থাকে না।
মধ্যমপন্থী অর্থাৎ দ্বাদশবাদী শিয়ারা চরমপন্থীদের উপরিউক্ত মতবাদে বিশ্বাস করেন না; বরং বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, এই চরমপন্থীরা ও তাদের মতবাদ মূল শিয়া মতবাদকে হেয়প্রতিপন্ন করেছে এবং তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে। মধ্যমপন্থী (্্ইমামী)-দের মতে, ইমাম মরণশীল; কিন্তু একটি অলৌকিক জ্যোতি আংশিক হুলুলক্রমে ইমামের মধ্যে অবস্থান করে। চরমপন্থী দ্রুজদের মতে, এটা একটি ধর্মীয় শক্তি, যা মৃত্যুকে ইমামরা আনন্দের বিষয় বলে গণ্য করে। ইমামের মৃত্যু তাঁর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে_এই তাদের বিশ্বাস। কারবালার যুদ্ধে হোসেন (তৃতীয় ইমাম) ইচ্ছা করে মৃত্যুবরণ করেন, যদিও আল্লাহ ওই যুদ্ধে বিজয়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছিলেন।
ইতিহাসের বিবর্তনে শিয়াদের উপরিউক্ত তিন সম্প্রদায় আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে যায়। জায়দি আন্দোলনের ফলে তাবারিস্তান ও দায়লামে ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ এবং ইয়েমেনে ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের জন্য এই রাজ্যগুলো ঐক্য স্থাপন করতে পারেনি। কারণ ধর্মীয় মতবাদে অনৈক্য ছিল। ইরাকের জায়দিরা কখনো স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি_তবে খলিফার সাম্রাজ্যে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে এই অক্ষমতার ক্ষতিপূরণ করে নিত।
ইমাম সম্পর্কে শিয়া-সুনি্নর বিশ্বাস : সুনি্ন মুসলমানদের মধ্যে ইমাম হচ্ছেন সুনি্ন সম্প্রদায়ের নেতা। সুনি্নদের মতে, খলিফা আইনের দাস, কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, ইমাম হচ্ছেন প্রধান আইন প্রবর্তক। সুনি্নদের খলিফা নির্বাচিত; কিন্তু শিয়াদের খলিফা পূর্ববর্তী ইমাম দ্বারা মনোনীত। শিয়াদের মতে, ইমাম ঐশী ইচ্ছায় সরাসরি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশোদ্ভূত। তারা মনে করে, হজরত আলীই ঐশীভাবে মনোনীত প্রথম ইমাম এবং খলিফা। শিয়াদের কাছে ইমামের 'আলা দরজা'। এর মাহাত্দ্য বিশাল। শিয়াদের মধ্যে একজন ইমাম নিযুক্তির পর তিনি অপসারিত হন না। কারণ এটা ঐশী নির্দেশিত। সুনি্নদের তা নয়।
(সহায়ক গ্রন্থ : শিয়া মতবাদ, আল্লামা মনযুর নৌমানী, ইসলামে ভিন্নমত ও ক্ষমতার লড়াই এবং আল্লামা মুহাম্মদ রেজা আল মুজাফ্ফর রচিত 'শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস)
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template