অনেক লোকের ভুল ধারণা আছে যে, ইসলাম একটা নতুন ধর্ম। যেটা এ পৃথিবীর বুকে এসেছে ১৪শ’ বছর আগে। আর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সত্য বলতে ইসলাম এ পৃথিবীতে বিরাজমান সেই সুদূর অতীত থেকেই, যখন প্রথম মানুষটি পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াত। আর হযরত মুহাম্মদ (স.) এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। তবে তিনি হলেন সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী এবং আল্লাহর শেষ রাসুল। তাঁকে পাঠানো হয়েছে সব মানুষের মঙ্গলের জন্য। পবিত্র কোরআন বলছে- অর্থ: “এমন কোন সম্প্রদায় নেই যেখানে আমি সতর্ককারী পাঠায়নি।” (সূরা ফাতির, আয়াত-২৪)
পবিত্র কোরআনের সূরা রাদ-এর সাত নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- “প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমি পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছি।” পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা পঁচিশ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন- আদম (আ), নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.), ঈসা (আ), মুহাম্মদ (স.)। তবে আল্লাহতায়ালা কোরআনে আরো বলেছেন- সূরা নি’সার ১৬৪নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে-
“আমি আগে তোমাকে বলেছি কিছু নবীদের কথা, কিছু রাসুলদের কথা, বাকিদের কথা বলিনি।” তার মানে পবিত্র কোরআনে সব নবী-রাসুলের কথা উল্লেখ করা নেই।
আর আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে প্রায় এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পাঠিয়েছেন (এ সহীহ হাদীসটি সংকলিত আছে মিশকাত আল মাসাবীহ শরীফের তিন নং খন্ডের হাদীস নং ৫৭৩৭-এ)। তবে নির্দিষ্ট নাম ধরে পবিত্র কোরআনে পঁচিশ জনের কথা বলা হয়েছে।” কিন্তু এইসব নবী বা রাসুল যারা এসেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আগে, তাঁরা এসেছিলেন শুধু তাদের সম্প্রদায়ের জন্য; আর তাঁরা যে কথাগুলো প্রচার করেছেন সে কথাগুলো মেনে চলা দরকার ছিল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
যেসব নবী-রাসুল হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আগে এসেছেন, তারা এসেছেন শুধু তাদের সম্প্রদায়ের জন্য। যেমন-হযরত ঈসা (আ:)। খ্রিস্টানেরা যাকে বলে যিশু খ্রিস্ট, তিনি এসেছিলেন শুধু ইহুদিদের জন্য, ইসরাইলের জন্য। সূরা ইমরানের ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- “ঈসা নবী বা যিশু খ্রিস্ট ছিলেন বনী ইসরাইলের জন্য একজন নবী হিসেবে।” এছাড়াও সূরা ছফের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “যিশু খ্রিস্ট ইসরাইলবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
“আমাকে এখানে আল্লাহর রাসুল হিসেবে পাঠানো হয়েছে।”
একই ধরনের কথা পবিত্র বাইবেলেও উল্লেখ আছে যে, যিশু খ্রিস্ট তাঁর অনুসারীদের বলেছেন যে, ‘তোমরা কেউ জেনটাইলদের পথ অনুসরণ করো না।’ (গসপেল অব ম্যাথিউ, অধ্যায়-১০, শ্লোক-৫-৬), এই জেনটাইল হলো ইহুদি।
তিনি আরো বলেন, “তোমরা কেউ সামারিটিল শহরে প্রবেশ করবে না। তার বদলে তোমরা ইসরাইলের শহরে প্রবেশ করবে।” একই ধরনের কথা উল্লেখ আছে, গসপেল অব ম্যাথিউর ১৫নং অধ্যায়ের ২৪ অনুচ্ছেদে- যেখানে যিশু খ্রিস্ট তাঁর মুখে বলেছেন যে, “আমাকে পাঠানো হয়েছে শুধু ইসরাইলবাসীদের পথ দেখানোর জন্য।” তার মানে হলো, কোরআন এবং বাইবেলের কথা অনুযায়ী যিশু খ্রিস্টকে পাঠানো হয়েছে শুধু বনী ইসরাইলীদের জন্য, ইহুদিদের সন্তানদের জন্য। তবে নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত নবী। সূরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে যে,
মুহাম্মদ (স.) তিনি তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন; তবে তিনি হলেন আল্লাহর প্রেরিত রাসুল এবং নবুয়াতের সিলমোহর। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সব বিষয়ে অবগত আছেন।
যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন আল্লাহর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রাসুল, সেজন্য তাঁকে শুধু মুসলিমদের জন্য পাঠানো হয়নি বা আরবদের জন্য। পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ১৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-
“আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।”
সূরা সাবার ২৮ নম্বর আয়াতে আরো বলা হয়েছে-
আমি তো তোমাকে পাঠিয়েছি পুরো মানবজাতির রাসুল হিসেবে। তুমি সুসংবাদ দেবে আর পাপ কাজে সতর্ক করবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এটা জানে না।
যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী। আমাদের নবীর পরে অন্য নবী বা রাসুল আসবেন না, সেহেতু তাঁকে শুধু মুসলিমদের জন্য বা শুধু আরবদের জন্য পাঠানো হয়নি। তাঁকে পাঠানো হয়েছে পুরো মানব জাতির জন্য। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, পবিত্র কোরআন হলো আল্লাহতায়ালার বাণী; এটা হলো আল্লাহর সর্বশেষ আসমানী কিতাব। তাই কোরআন যা বলছে আমরা তাই মানি। সেজন্য আমরা এটাও মানি যে, নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) হলেন সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী আর এটাও মানি যে তাঁকে পাঠানো হয়েছে পুরো মানব জাতির জন্য। তবে বেশিরভাগ অমুসলিম, সাধারণভাবে সব অমুসলিমই বিশ্বাস করে না যে, কোরআন আল্লাহর বাণী। আর সে কারণে তারা মানতে চায় না যে, নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী এবং তিনি এসেছেন পুরো মানুষ জাতির জন্য। এ কারণে অমুসলিমদেরকে বুঝানোর জন্য আমি এখানে সাহায্য আর নির্দেশনা নেবো পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে। আর আমার মতে এ আয়াতে আছে হেদায়াতের চাবিকাঠি ও অমুসলিমদেরকে বোঝানোর মূল মন্ত্র ও দিক-নির্দেশনা।
পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ৬৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে-
“এসো এ কথায় যা আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে এক”।
যখন আমরা অন্য ধর্মের মানুষের কথা বলবো, সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি যেটা পবিত্র কোরআন বলেছে- “এসো সেই কথায় যাহা আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে এক।” আসুন আমরা দেখি যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোতে নবী হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে কি বলা আছে। তা হলে অমুসলিমরা যদি বিশ্বাস করে যে, এই ধর্মগ্রন্থগুলো, যেটা তাদের ধর্মের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। তাহলে সেই ধর্মগ্রন্থের কথাগুলো তাদের মানতে হবে।
প্রথমেই আমরা দেখি, হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে কি বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোকে মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ‘শ্রুিত’ আর ‘স্মৃতি’। শ্রুতি সম্পর্কে অর্থ যেটা প্রকাশিত হয়েছে, যেটা সবাই বুঝতে পেরেছে, যেটা মানুষ শুনেছে। এই শ্রুতি বিভিন্ন হিন্দু বিশেষজ্ঞদের মতে প্রচলিত আছে যে, শ্রুতি হলো ঈশ্বরের বাণী। এটাও আবার প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। বেদ ও উপনিষদ। ‘বেদ’, এ সংস্কৃত শব্দটি এসেছে ‘বিদ’ থেকে, যার অর্থ মানুষের জ্ঞান। আর বেদ প্রধানত চার প্রকার। ঋক্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। যদিও এ বেদগুলো ঠিক কোন্ সময় হতে পৃথিবীতে আছে সেটা নির্দিষ্ট করে কেউ জানে না। তবে স্বামী দেবানন্দ স্বরস্বতীর কথা অনুযায়ী, যিনি হলেন আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি বলেন, আসলে এ বেদগুলোর বয়স একশ’ একত্রিশ কোটি বছর। তবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই বলেন, বেদের বয়স আনুমানিক চার হাজার বছর।
পৃথিবীর কোন্ অংশে এই বেদ প্রথম এসেছিল সেটাও আমরা কেউ জানি না। কার উপরে এটা অবতীর্ণ হয়েছিল সেটাও আমরা জানি না। যদিও এ ব্যাপারগুলো পরিষ্কার নয়, তারপরও হিন্দুরা মনে করে যে এটাই সৃষ্টিকর্তার বাণী এবং সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থ যাবতীয় হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে। এর পরে গুরুত্ব পাবে তাদের উপনিষদ। উপনিষদ এসেছে সংস্কৃতি শব্দ ‘উপা’ থেকে যার অর্থ কাছে। ‘নি’ অর্থ নিচে এবং ‘ষদ’ অর্থ বসা। অর্থাৎ কাছে এসে বসা। এককালে ছাত্ররা বসত তাদের শিক্ষকদের পায়ের কাছে। এটাকে বলা হচ্ছে ‘উপনিষদ’। এটার অর্থ হলো জ্ঞান যা যাবতীয় অজ্ঞতা দূর করে দেয়। পৃথিবীতে দুশো’র বেশি উপনিষদ পাওয়া যায়, তবে হিন্দুরীতি বলে এর সংখ্যা হলো একশ’ আট। এগুলোর মধ্যে কিছু উপনিষদকে বলা হয়েছে প্রধান উপনিষদ। কেউ বলে দশটা, কেউ বারোটা, শ্রী রাধাকৃষ্ণ ১৮টি নিয়ে বই লিখেছেন। এগুলোকে বলে প্রধান উপনিষদ।
পরের স্তরের ধর্মগ্রন্থগুলো হলো ‘স্মৃতি’। স্মৃতি মানে যেগুলো মনে রাখা হয় অর্থাৎ স্মরণে রাখা। হিন্দু বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই স্মৃতি নামক গ্রন্থগুলো মানুষ লিখেছে- মানে ঋষিরা। আর এর অবস্থান শ্রুতির পরে। এগুলোকে বলে ধর্মশাস্ত্র। কারণ এগুলো বলে যে, একজন মানুষ কিভাবে চলবে, সম্প্রদায় কিভাবে চলবে, সমাজ কিভাবে চলবে। স্মৃতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন ‘পুরাণ’। পুরাণ অর্থ প্রাচীন। এসব পুরাণে বিভিন্ন দেবতার কথা আছে, বিশ্ব সৃষ্টির কথা আছে, সাহিত্য আছে। আর মহাঋষি ব্যাস দেব এ পুরাণগুলোকে ১৮টি খন্ডে ভাগ করেছেন। এগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পুরাণ হলো ভবিষ্য পুরাণ। ভবিষ্য মানে ভবিষ্যৎ। এ পুরাণ ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছে।
আর ভবিষ্য পুরাণের তৃতীয় পর্ব তৃতীয় খন্ড ৫-৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, একজন ম্লেচ্ছ মুসলমান আসবেন তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে মরুভূমি থেকে। তার নাম হবে হযরত মুহাম্মদ (স.)। রাজা ভোজ এ দেবতুল্য মানুষকে স্নান করিয়ে পবিত্র করবেন। তাঁকে স্বাগত জানাবেন সম্মানের সাথে। তাঁর সাথে কথা বলবেন শ্রদ্ধার সাথে। আর বলবেন, হে মানব জাতির গর্ব, আপনি শয়তানকে হারানোর জন্য এক বিশাল বাহিনী বানিয়েছেন। ম্লেচ্ছ এ সংস্কৃত শব্দটির অর্থ বিদেশী। তিনি আসবেন তাঁর সঙ্গীদের সাথে নিয়ে। এখানে সাহাবাদের কথা বলা হচ্ছে। আসবেন মুরস্থল থেকে। সংস্কৃত মুরস্থল শব্দের অর্থ বালিময় স্থান বা মরুভূমি। তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ (স.)। রাজা ভোজ এ বিদেশীর সাথে কথা বলবেন শ্রদ্ধার সাথে আর বলবেন- হে মানবজাতির গর্ব। আপনারা জানেন যে, মুহাম্মদ (স.) তিনি মানব জাতির গর্ব। পবিত্র কোরআনের সূরা কালামের ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- “নিশ্চয় তুমি সবচেয়ে মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।”
এছাড়া সূরা আহযাবের ২১নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- “নিশ্চয় আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (স.)-এর মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।”
কুরআন আরো বলছে যে, সেই লোক তাঁর বাহিনী নিয়ে শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমরা জানি আমাদের প্রিয় নবীজি এই কাজটা করেছিলেন। এ ভবিষ্যৎ বাণীই স্পষ্ট প্রমাণ দেয় এখানে মুহাম্মদ (স.)-এর কথা বলছে। (চলবে)
গ্রন্থণা:
মাওলানা জাকির সোসাইন আজাদী
+ comments + 2 comments
ধন্যবাদ ...............।।
জাকির নাইকের লেখা থেকে আরও লিখবেন এই প্রত্যাশা।
ধন্যবাদ ...............।।
জাকির নাইকের লেখা থেকে আরও লিখবেন এই প্রত্যাশা।
www.salafibd.wordpress.com
Post a Comment