السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

হিজাব নিয়ে ভাবনা - কাশফিয়া নেহরীন

| comments

আমার ক’জন সহকর্মী যেভাবে মাথা ঢেকে হিজাব পরে বাইরে চলাফেরা করে, ওদের সাথে না মিশলে বুঝতেই পারতাম না যে ওরা অমুসলিম। অথচ ওরা অনেকেই আমেরিকা, বৃটিশ বা কানাডার মত পশ্চিমা দেশের নাগরিক। আপাতঃ দৃষ্টিতে এরা সৌদি আরবের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই হিজাব পরে। হিজাবের সামাজিক প্রভাব নিয়ে কথা বললে ওরা উৎসাহ নিয়ে শুনতে চায়। অথচ মুসলিম নারীরাই আজ হিজাব পরা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভূগছে। মুসলিম মেয়েদের একটি বিরাট অংশ এখনো হিজাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবারই সময় পায় না।
আমার ছোটবেলার এক বান্ধবীর কথাই বলি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এখন পিজিতে এফসিপিএস করছে। তার সাথে প্রায়ই টেলিফোনে কথা হয়। সেদিন ওকে বললাম কি রে? তোরা যখন হজ্ব ওমরাহ করতে আসিস, তখনতো সুন্দর করে হিজাব পরিস। দেশে ফিরে গিয়ে সেই মাথার কাপড় যায় কোথায়? উত্তরে সে বলেছিল - আমাদের ওমরাহ তো ওখানেই শেষ। তা তো আর সাথে করে নিয়ে আসিনা। সাথে সাথে না হলেও পরে বুঝতে পারলাম বড় ধরনের ধোঁকায় আছে আমার সেই বান্ধবীটি। আল্লাহর বিধান নিয়ে এভাবেই গোমরাহীতে রয়েছে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মেয়েরা।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক হিজাব কি? হিজাব অর্থ ঢেকে রাখা। মেয়েদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ (দু হাত ও মুখ ছাড়া) বড় চাদর কিংবা বোরখা সদৃশ ঢিলেঢালা পোষাক দ্বারা আবৃত করে পর পুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে চলার যে পদ্ধতি বা ব্যবস্থা তাই মুসলিম সমাজে হিজাব বলে পরিচিত। চুল নারীর সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ, তাই তা খোলা রেখে বাইরে চলাফেরা করা জায়েয নয়। যদিও ক্ষেত্র বিশেষে মুখ খোলা রাখার ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে, তবে মুখই যেহেতু মেয়েদের সৌন্দর্য ও শোভার আসল কেন্দ্র তাই পর পুরুষের সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ খোলা নারীর জন্যে শোভনীয় নয় এবং বিনা প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃতভাবে তার দিকে দৃষ্টিপাত করাও পুরুষের জন্য জায়েয নয়। তাইতো পর্দা প্রত্যেক মেয়ের জন্যেই ফরজ, যারা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেছে।
হিজাব বা পর্দা কোন সামাজিক প্রথা নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ, যা পালন করা মুসলিম মেয়েদের উপর ফরজ। পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমীনদের স্ত্রীগণকে বলুন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবেনা। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”
হিজাব বাস্তবেই মেয়েদের সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করে, সুনিশ্চিত করে। রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া দু’টি মেয়ে, যাদের একজন হিজাব পরে ও অন্যজন খোলা চুল এলিয়ে আঁট সাঁট পোষাক পরে চলছে - রাস্তার বখাটে ছেলেরা সহজে উত্যক্ত করবে হিজাব বিহীন মেয়েটিকে। পত্রিকার পাতা খুললে এ ধরনের নারী উত্যক্ত হবার খবর অহরহ আমাদের চোখে পড়ে।
আল্লাহর বিধান অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ এ যেন মেয়েদের পাওনা। অথচ হিজাব পরিহিতা মেয়েদের সম্ভ্রম আল্লাহই রক্ষা করেন। এ দুনিয়ায় এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও রয়েছে মহান পুরস্কার। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নুরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন “ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতৃষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রী লোক, অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌন কামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সর্ম্পকে অজ্ঞ - তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ সজ্জা প্রকাশ করার জন্যে জোরে পদচারণা না করে। মুমীনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”
পর্দাতে আল্লাহর নিজস্ব কোন লাভ নেই। লাভতো সেই বান্দার যে নিজেকে রেখেছে পর্দার মধ্যে ও সমাজ করেছে কলুষমুক্ত। সেই বান্দার জন্য জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করা হয়েছে। যে জান্নাত আমরা কখনো চোখ দিয়ে দেখিনি। সেখানে সে থাকবে অনন্তকাল। আল্লাহর বান্দারা যদি তা বুঝতো তাহলে সবাই উগ্রতা পরিহার করে নিজেকে আবৃত করার প্রতিযোগীতায় এগিয়ে আসত।
আজকের সমাজে আমাদের নারীরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত বেশী সাজগোজ করে বাইরে যেতে পারে। প্রবৃত্তির প্ররোচনায় ঢাকা পড়েছে সুচিন্তা ও বিবেক। মেয়েদের সৌন্দর্য সবার সামনে অবারিত করাই যেন আধুনিক ফ্যাশন। নারী সমাজ বেমালুম ভুলে আছেন যে, আল্লাহ সর্বাবস্থায় আমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন। আমাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা বা ভয় থাকলে দুনিয়ার চাকচিক্যময় এসব ফ্যাশন-মরিচিকা উপক্ষো করে আল্লাহর পছন্দনীয় ‘হিজাব’ গ্রহণ করা হবে বুদ্ধিমতীর কাজ।
আজকের পর্দাশীলা নারীদের দেখে হয়তো অনেকে পুরাতন ফ্যাশন মনে করছে। কিন্তু পরকালে এ সব নারীদেরই জয় হবে ইন্‌শা’আল্লাহ। আর যারা তাদের দেখে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে বা আধুনিকতার নামে পর্দা করা থেকে দূরে থেকেছে, তাদের রাস্তা হবে কন্টকপূর্ণ এবং আল্লাহর রাগ বর্ষিত হবে তাদের উপর। আর ওদের নিবাস হবে জান্নাত নয় বরং জাহান্নাম।
নারীদের জন্যে গৃহই উত্তম। অর্থাৎ শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিত তারা বাইরে বের হবেনা। যদি নারীকে বাড়ী থেকে বের হতে হয়, তবে যেন সৌন্দর্য ও দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শন না করে বের হয়। বরং বোরকা বা হিজাব পরেই বের হবে। পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবে আল্লাহ বলেছেন “তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবেনা। নামাজ কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে।”
এই আয়াত থেকে এটা পরিস্কার যে, দেহ সৌন্দর্য প্রদর্শন করার জন্য বাইরে ঘুরাফেরা করা মেয়েদের জন্য জায়েজ নয়। তবে প্রয়োজনীয় কাজে কিংবা শিক্ষা ও চাকুরীর প্রয়োজনে হিজাব পরে চলাফেরা করতে ইসলাম মেয়েদের উপর কঠোরতা আরোপ করেনি।
পর্দার কারণে বাংলাদেশে তিনটি বোনকে জেল হাজত খাটতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্ত করা হয়েছে। এ যেন এক অকল্পনীয় অধ্যায়। এ খবর শুনার পর নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। ঐ তিনটি বোনকে রাস্তার বখাটেরা ধাওয়া করলে দৌড়ে আশ্রয় নেয় নিকটতম মাদ্রাসায়। বখাটেরা পুলিশ এনে এদের জঙ্গি বলে ধরিয়ে দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও জঙ্গি কানেকশনের কোন যোগসূত্র মিলাতে পারেনি। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হয়েও পর্দা করার কারণে মেয়েদের জেলে পর্যন্ত যেতে হয়।
সমাজে আধুনিকতার নামে গায়ের ওড়না হয়েছে মাফলার বা কোন কোন ক্ষেত্রে ওড়নাই নেই। যত বেশি খোলামেলা পোশাক পরা যায় ততবেশি আধুনিক। এ আধুনিকতা মেয়েদের পণ্য বানিয়ে রেখেছে। টিভির বিজ্ঞাপনগুলোতে মেয়েদের চিত্র প্রদর্শনীই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাগাজিনের কভারে কোন মডেল কন্যার ছবি ছাপলেই বেশি বিক্রি হচ্ছে এবং আমাদের সমাজকে করছে কুলষিত। ভবিষ্যতই হয়তো বলে দেবে এই দেহ সৌন্দর্য প্রদর্শনী তাদেরকে কত নীচে নামিয়েছে।
হাদীসে এসেছে হযরত উম্মে সালমা (রা) থেকে বর্ণিত - একদা হযরত মায়মুনাহ এবং আমি বসেছিলাম হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সাথে। তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম এসেছিলেন। নবীজি ওদের বললেন পর্দা করতে। হযরত সালমা (রাঃ) বললেন, উনিতো অন্ধ। জবাবে রাসূল (সঃ) বললেন তুমিতো আর অন্ধ নও। (আবু দাউদ, তিরমিজী) অর্থাৎ মেয়েদেরকে মাহরাম ব্যতিত পুরুষদের দেখাও জায়েজ নয়।
বোনদের প্রতি অনুরোধ যারা এখনো হিজাব নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন, একটু ভেবে দেখুনতো, কোরআনের কোন সূরায় আছে অর্ধঢাকা বা পুরোটাই খোলা রেখে বাইরে চলাফেরা করা যায়। আপনারা যারা ওমরাহ-হজ্ব পালন করতে মক্কা-মদীনায় আসেন তারাও একটু ভেবে দেখুন। এ সব এলাকায় কোন রাহাজানি, ধর্ষণ, লুন্ঠন হয়না কেন? এর উত্তর - এ এক অতীব নিরপদ প্রাঙ্গন। আমরা সৌদি আরবে অত্যন্ত সুন্দরী মেয়েকে পর্দা সহকারে শালীন ভাবে পথ চলতে দেখেছি। তাদের সৌন্দর্য বিশ্ব সুন্দরীকেও হার মানায়। পর্দা তাদেরকে আরও সম্মানিত ও মহিমান্বিত করেছে।
অথচ আমরা প্রাশ্চাত্যের অশালীনতাকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদেরকে যেমন অসম্মানিত করছি, একইভাবে সমাজকে করছি কলুষিত। দেশের প্রত্যেক নারীর আজ হিজাব নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। ভালবাসতে হবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে। অন্যের ধার করা পোশাক পরিধান থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন ধরণের কুসংস্কারকে রুখতে হবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে।
পর্দা করা নারীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ব্যাপার নয় বরং এটা স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ। কোন নারী যদি এতদিন পর্দা না করে থাকেন সে জন্যে তিনি যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং ভবিষ্যতে পর্দা করার জন্যে দৃঢ় সংকল্প করেন তাহলে আল্লাহ তাকে নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। সূরা বাকারাহ ২৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “···তারা বলে আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”
আসুন পর্দা পালনের মাধ্যমে আমরা নারীরা সমাজে আমাদের সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে উগ্রতাকে পরিহার করে শালীনতা অর্জন করি। সর্বোপরি আখেরাতেও সফল নারীদের কাতারে দাঁড়ানোর দৃঢ় বাসনা নিয়ে এগিয়ে চলি।
লেখিকাঃ লেকচারার, প্রিন্স সুলতান ইউনিভার্সিটি, রিয়াদ, সৌদি আরব
ইমেইল
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template