السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

পবিত্র ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য-প্রফেসর ড. আ ন ম রইছ উদ্দিন

| comments

[লেখকঃ সাবেক চেয়ারম্যান, ইসঃ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাবি]
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেমে সর্বোচ্চ উৎসর্গ, নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান বা নিজেকে কুরবানী করার অর্থাৎ আত্মোৎসর্গের আদর্শ অনুসরণই ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা অর্থ কুরবানী বা যবাই এর খুশি। কিন্তু কুরবানী বা যবাই এর মধ্যে আবার খুশি কিসের? অপরদিকে কুরবানী বা জবাই বলতে কিন্তু শুধু জীব কুরবানী বা যবাই করা নয়। স্বাভাবিকভাবে একথাও বোধগম্য নয় যে, আত্মউৎসর্গ মানে নিজেকে উৎসর্গ করা, কোন পশুকে উৎসর্গ করা নয়। কিন্তু ঈদুল আযহায় কেউ কি নিজেকে উৎসর্গ করে? তাহলে কি আমাদের কুরবানী হয় না? কেননা, আমরা তো নিজেকে কুরবানী করি না। বস্তুত ঈদুল আযহার উদ্দেশ্য নিজেকেই কুরবানী বা উৎসর্গ করা এবং সে মতে আমরা নিজেদেরকেই উৎসর্গ করি প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানী করার মাধ্যমে। কেননা, যে মহান আত্মদানকে কেন্দ্র করে এই কুরবানী, তা হলো হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)কে কুরবানী করা। ইব্রাহীম (আ.) তো চোখ বেঁধে তার পুত্রকেই কুরবানী করেছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় চোখ খুলে দেখলেন হযরত ইসমাইলের পরিবর্তে একটি পশু কুরবানী হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর প্রেমে নিজেকেই কুরবানী বা আত্মদান করেছিলেন নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে। যদিও সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইব্রাহীম (আ.) উক্ত অগ্নি পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং আল্লাহতা’য়ালার অশেষ কৃপায় অগ্নিকুণ্ড পরিণত হয়েছিল ফুলের বাগানে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহতা’য়ালা আগুনকে এ বলে নির্দেশ প্রদান করলেন, ইয়া নারু কুনি বারদাও ওয়া সালামান আলা ইবরাহীম’ অর্থাৎ হে আগুন ইব্রাহীম (আ.) যেন শান্তিতে থাকে এমনভাবে শীতল হয়ে যাও’ (২১ঃ৬৯)। ফলে ইব্রাহীম (আ.) তথায় জান্নাতের শান্তি উপভোগ করলেন।


বস্তুত ঈদুল আযহার মাধ্যমে আত্মদান বা পশুদান-এর উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর প্রেমে একজন প্রকৃত মুমিন তার সর্বাধিক প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে পারে কিনা তারই পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পরিশুদ্ধ আত্মায় মহান আল্লাহর মহাপবিত্র প্রেমের প্রয়োজন। যে বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ মুমিনদের সর্বাধিক প্রেম হবে আল্লাহরই জন্য’(২ঃ১৬৫)। উক্ত প্রেম অর্জনের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধির প্রয়োজন। আর আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য মানুষের মধ্যে যে পশুগুলো বা পাশবিক শক্তি আছে, তাকেই কুরবানী দিতে হয়।


তাই ঈদুল আযহার পশু কুরবানীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশু শক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কুরবানী দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কুরবানীর মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। কারণ, পশু বা পশুর গোশত বা চামড়া কোনটাই আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই এবং তা দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করা যায় না, বরং এর মাধ্যমে যে তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে- তা দিয়েই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করা যায়। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন যে, ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বরং এর মাধ্যমে যে তাকওয়া বা অন্তর্নিহিত প্রেম রয়েছে তাই শুধু আল্লাহর কাছে পৌঁছায়।


বস্তুত ঈদুল আযহার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ তথা মানব জাতির জন্যে যে শিক্ষা রয়েছে তা হলো মহান আল্লাহর প্রেমে সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা। আর তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ ‘লান তানালুল বিররা হাত্তা তুনফিকু মিম্মা তুহিব্বুন’ অর্থাৎ তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রতিদান বা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সর্বাধিক প্রিয় বস্তু তারই (আল্লাহর) জন্য ব্যয় করতে না পার (৩ঃ৯২)। আর এ ত্যাগের জন্য মন বা আত্মার পবিত্রতা ও নিষ্ঠা অপরিহার্য। আল্লাহতা’য়ালা মহানবী (সা.)কে সম্মোধন করে বলেনঃ ‘কুল ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বীল আলামীন।’ অর্থাৎ ‘বলুন আমার সালাত আমার ত্যাগ, আমার জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর জন্য’ (৬ঃ১৬২)। আর এ জন্য আত্মার পবিত্রতা প্রয়োজন। আর আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়, দূর হয় মনের সকল কালিমা। মানুষ তথা সৃষ্টির অকল্যাণ হয় এমন কাজের কথা তখন চিন্তাও করা যায় না। এ সৃষ্টি প্রেমের মাধ্যমে লাভ করা যায় স্রষ্টার প্রেম, এমনি অবস্থায় মনে আসে অনাবিল শান্তি ও আনন্দ, যা মানব জীবনের পরম কাম্য। তাহলে বুঝা গেল, ঈদুল আযহা বা কুরবানীর আনন্দ বলতে পশু কুরবানীর সাথে সাথে মানুষের মধ্যে যে অশুভ পশু শক্তি রয়েছে তাকে কুরবানী বা বিসর্জন দিতে পারার কারণেই এই আনন্দ। তাই ভেবে দেখতে হবে, আমরা ঈদুল আযহার এ মহাপবিত্র লগ্নে আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে পেরেছি কি? কুরবানীর অপর আনন্দ হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে মানব তথা সৃষ্টির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা। ত্যাগের মহিমায় মুসলিম উম্মাহ তথা মানব জাতিকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই প্রতিবছর আমাদের জন্য আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদুল আযহা। এই পবিত্র লগ্ন আমাদেরকে প্রতিবছর স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ত্যাগের মহিমায় ধন্য হয়ে প্রকৃত মানবিক গুণাবলী অর্জন করার মাধ্যমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মহাশান্তি লাভ করার সুযোগ হয়তো কারো কারো জীবনে আর নাও আসতে পারে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা মানুষকে এ পৃথিবীতে নির্ধারিত সময়ের জন্যেই পাঠিয়েছেন। এ সময়ের যেদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে, সেদিন কোন শক্তিকেই এ সময় বৃদ্ধি করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। সুতরাং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে। না হয় জীবন অবসান ক্ষণে কান্নাকাটি বা অনুনয়-বিনয় কোনই কাজে আসবে না। এ সম্পর্কেও আল্লাহতা’য়ালা পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে, জীবনের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ ব্যক্তি সেদিন ফরিয়াদ করে বলবেঃ হে প্রভু, পৃথিবীতে থাকার আর একটু যদি সুযোগ দিতে তাহলে তোমার নির্দেশানুযায়ী জীবন-যাপন করে ও সর্বস্ব উৎসর্গ করে সৎ মানুষ হয়ে ফিরতাম। কিন্তু এতে কোন লাভ হবে না। কেন না নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে এক মুহূর্তেও বাড়ানো-কমানো হবে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনেই ঘোষিত হয়েছেঃ ‘তাদের নির্ধারিত সময় সমাপ্ত হওয়ার পর এক মুহূর্ত পূর্বে বা পরে তাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটানো হবে না।’ (১০ঃ৪৯) এবং (১৬ঃ৬১)। বরং নির্ধারিত সময়ই প্রতিটি মানুষকে এ পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে।


তাই সময় থাকতেই আমাদের আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা উচিত এবং মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার মনোভাব হওয়া উচিত, যেন পশু কুরবানির সাথে-সাথে আমাদের কুপ্রবৃত্তি বা পশুশক্তির কুরবানি হয়ে যায় এবং আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গের মাধ্যমে অসহায়, নিরাশ্রয় ও অনাথ মানুষের মুখে হাসি ফুটে, তাহলেই ঈদুল আযহার আনন্দ সত্যিকারের আনন্দ হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে মানবপ্রেম তথা সৃষ্টি প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রেমার্জনে আত্মোৎসর্গ করার শক্তিদান করুন, আমীন।
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template