[লেখক ঃ সাবেক পরিচালক, ইসঃ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ]
কুরবানীর অর্থ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঃ কুরবানী বা উদ্হিয়্যা দুটোই আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঐ পশু যা কুরবানীর নির্দিষ্ট দিন সমূহে যবেহ করা হয়। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কুরবানীর অর্থ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে পশু যবেহ করা। (শামী ৫ম খন্ড, পৃ. ২১৯) মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবাণী হযরত আদম (আ:)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের করা কুরবাণী। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, “আর আপনি আদমের দুই পুত্রের ঘটনা তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের কুরবাণী কবুল হল এবং অন্যজনের কবুল হল না।” সূরায়ে মায়েদা আয়াত:২৭) কুরবাণীর বিধান আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ হতে নাযিলকৃত সকল শরীয়তেই নির্ধারিত ছিল, কুরআন কারীমে বলা হয়েছে, “আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে” (সূরায়ে হজ্ব, আয়াত ৩৪)। ইতিহাসের এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানে প্রচলিত আমাদের কুরবানী মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও তাঁর বৃদ্ধ বয়সের প্রিয়তম পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর কুরবানীর অপূর্ব ঘটনারই স্মৃতিবহন করে। এ বিষয়ে আল কুরআনে বলা হয়েছে, “তার পর হযরত ইসমাঈল (আ.) যখন তাঁর পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইব্রাহীম (আ:) বললেনঃ হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? তিনি বললেন, হে আমার পিতা আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন। ইনশাআল্লাহ্ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইব্রাহীম তাঁর পুত্রকে শোয়ালেন তখন আমি তাঁকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম? আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলেন। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এ ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। আমি তা পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রেখেছি। ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি সৎ কর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। (সূরায়ে সাফ্ফাত, আয়াত:১০২) বস্তুত হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর কুরবানীর এই অবিস্মরণীয় ঘটনাকে জীবন্ত রাখার জন্য এবং পশু কুরবানীর মাধ্যমে মানুষের অন্তরে নিহিত পশু বৃত্তিকে কুরবানী করার জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর উপরও তা ওয়াজিব করা হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, “সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাউসার, আয়াত:২)
কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
মানুষের নেক আমল সমূহের মধ্যে কুরবাণী অন্যতম একটি নেক আমল। এ কারণেই নবী করীম (স:) সব সময় নিজে কুরবাণী করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কুরবানী করেন না তাদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ্ বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনা সে যেন কুরবানীর ঈদের নামায পড়ার জন্য আমাদের ঈদ গাহে না আসে।” (ইবনুমাজা) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ারাসুলাল্লাহ্। কুরবানী কী? তিনি বললেন, কুরবানী হচ্ছে তোমাদের জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ:)-এর সুন্নাত। তারা আবার বললেন, এতে আমাদের কী কল্যাণ নিহিত রয়েছে? তিনি বললেন, এর একটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, বকরীর পশমেও কি তাই? জওয়াবে বললেন, বকরীর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে সওয়াব রয়েছে (ইবন মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)। কেবল গোশত ও রক্ত প্রবাহের নাম কুরবাণী নয়। বরং পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজের ভিতরকার পশুবৃত্তি দূর করার উদ্দেশ্য আল্লাহ্র রাস্তায় তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কুরবানী। বস্তুত কুরবানীদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না বরং সে তো ছুরি চালায় তার অন্তরে থাকা সকল কুপ্রবৃত্তির গলায় আল্লাহ্র প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই হল কুরবানীর মূল নিয়ামক শক্তি। এ অনুভূতি ছাড়া কুরবাণী করা হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ:) এর সুন্নাত নয়। এটা একটি প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু ঐ তাকওয়া হাসিল হয় না যা কুরবানীর প্রাণশক্তি। আল কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ্র নিকট পৌঁছায় না কুরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্ব, আয়াত:৩৭) কুরআনে করীমে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “অবশ্যই আল্লাহ্ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন।” (সূরা মায়িদা, আয়াতঃ২৭)
কুরবানীর অর্থনৈতিক প্রভাব ঃ
অজ্ঞতার কারণে কেউ কেউ বলতে চান কুরবাণীর ফলে দেশে ব্যাপক পশু নিধন হয় যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কথাটি আদৌ সঠিক নয়। বরং এ কুরবানীর ফলে একটি পশু নিধনে শত শত পশু জন্ম নেয়। কেননা কুরবানীর জন্য সারা বছর পশু পালনকারী ও পশু ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী অসংখ্য গরু, মহিষ, ছাগল, উট লালন পালন করা হয় এবং কুরবানীর সময় এগুলো বিক্রির ফলে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়, দারিদ্র্য বিমোচন হয়, মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ে। অনুরূপভাবে কুরবানীর পশুর চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার পরও বিদেশে রপ্তানি করে দেশে ব্যাপক হারে বৈদেশিক অর্থ অর্জন করা যায়। অপরদিকে, কুরবানীর পশুর হাড় ও বর্জ্য দ্বারা সার তৈরী করে একদিকে দেশের আভ্যন্তরীণ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় অপরদিকে উদ্বৃত্ত সার বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। তাছাড়া বর্তমানে পশুর হাড়ের দ্বারা তৈরি ওষুধের ক্যাপসুলের মোড়ক তৈরী করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এক্ষেত্রেও কুরবানীর পশুর হাড়ের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
কুরবানীর মূল শিক্ষা হচ্ছে- তাকওয়া বা পরহেজগারিতা বাড়ানোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করা করুন আমীন।
Post a Comment