السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

ধর্ম জীবনকে পরিশীলিত করে - এম. কে. দেওয়ান

| comments

মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আল্লাহ্ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, দিবা-রাত্র, মেঘ-বৃষ্টি এবং বিভিন্ন প্রাণীকুল, বৃক্ষরাজি, ফলরাশি ও শস্যাদি। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার্থে ধরাপৃষ্ঠে স্থাপন করা হয়েছে পাহাড়, সাগর, নদী, সমতলভূমি ইত্যাদি। আল্লাহ্ মানব সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি রূপে যেন মানুষ পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও কলা-কৌশল প্রয়োগ দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের সদ্ব্যবহার করত: সেগুলো থেকে উপকার ভোগ করে। আল্লাহ্ কোরআনে এরশাদ করেছেন, নদ-নদী, সাগর-সমুদ্র, চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করতে প্রয়োজন কঠোর শ্রম ও অনন্ত প্রয়াস। পরিশ্রম করার আহবান জানিয়ে আল্লাহ্ তাঁর রাসুল (সা:) কে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘ও মোহাম্মদ, আপনি লোকদের বলে দিন, তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে সকলেই পরিশ্রম কর; আরো বলে দিন যে, আপনি নিজেও একজন পরিশ্রমী মানুষ’ (৩৯:৩৯)। আল্লাহ্ রাসুল (সা:) এবং তাঁর সাহাবীগণ কায়িক পরিশ্রম দ্বারা যাবতীয় কাজ যথা-শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমরক্ষেত্রে নিজেরাই যুদ্ধ করেছেন, রাস্তা-ঘাট, মসজিদ, বাসস্থান নির্মাণ, সমাজগঠন এবং জীবিকার্জনের জন্য ব্যবসা করা ইত্যকার যাবতীয় কাজ নিজেরাই করেছেন। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসুল (সা:) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা দিবাভাগে জীবিকার্জনের জন্য নিয়োজিত থাক’। তিনি আরো বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি উৎকৃষ্ট আহার ভক্ষণ করে, যে স্বীয় কায়িক পরিশ্রম দ্বারা তা উপার্জন করে। আল্লাহ্ কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘যারা স্বীয় প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম দ্বারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে না, আল্লাহ্ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না, (১৩:১১)। রাসুল (সা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় পরিবারের অভাবমুক্ত জীবন-যাপনের উদ্দেশ্য এবং প্রতিবেশীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করার মানসে সৎ উপার্জন করে, সে পরকালে পূর্ণচন্দ্রিমার ন্যায় উজ্জ্বল মুখে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে।’ লক্ষণীয় যে, জীবনযাত্রার জন্য ইসলাম পরিশ্রম এবং অর্থোপার্জনের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ আরো এরশাদ করেছেন, ‘যখন নামাজের জন্য তোমাদের আহবান করা (আজান দেওয়া) হয়, তখন হাতের কাজ স্থগিত রেখে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ্র ইবাদতে শরীক হও এবং নামাজ শেষে, পুনরায় নিজ নিজ কর্মস্থলে ছুটে যাও ও জীবিকার অন্বেষণে নিজেদেরকে নিয়োজিত কর’ (৬২:৯)। শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদত যথা- নামাজ রোজা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত না থেকে, আরো যেসব সামাজিক কর্তব্য রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে, ‘শুধু পূর্ব, পশ্চিম দিকে সিজদা করলেই পুণ্য হবে না, বরং আল্লাহ্, রাসুল (সা:), ঐশীগ্রন্থ, পরকাল প্রভৃতির উপর ঈমান এনে পিতা-মাতা, নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এতিম, অভাবগ্রস্ত প্রভৃতিদের প্রতি আর্থ-সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাতেও পুণ্য রয়েছে’ (২:১৭৭)। ইসলামের বিধানে কোন মুসলমানের দায়-দায়িত্ব তার ব্যক্তিগত ও স্বীয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রত্যেক মুসলমান সমগ্র মানবসমাজ তথা আল্লাহ্র বৃহত্তর পরিবারের কল্যাণের প্রতিও দায়বদ্ধ। আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা। নামাজের সময় সমাজের, লোকজন সমবেতভাবে অর্থাৎ জামাতে একত্রে নামাজ পড়ে। বিশ্বের সকল মুসলমান একত্রে সম্মিলিত হয়ে একই নির্দিষ্ট দিনে এবং একই নির্দিষ্ট স্থানে হজ্বব্রত পালন করে। এমনিভাবে একত্রে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, ঐক্য প্রগাঢ় হয়। সংগঠিতভাবে, ধর্ম পালনের উপকারিতা ও কল্যাণ বহুবিধ, অপরিসীম। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ইবাদত। সমাজে লক্ষ্য করা যায় যে, ধর্মপ্রাণ কোন ব্যক্তি অজ্ঞাতে বা অসাবধানবশত: কোন ভুল কাজ করলে, কেউ কেউ তজ্জন্য ইসলাম ধর্ম ও ধার্মিক লোকদের সম্পর্কে কটুক্তি করে থাকেন। এরূপ সমালোচনা করা অযৌক্তিক। কেউ অপরাধ করলে সেটা সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্খলন। কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্খলনের জন্য তার ধর্ম বা তার ধর্মসম্প্রদায়কে দায়ী করা যুক্তিসিদ্ধ নয়। যা হোক, ইসলামে আনুষ্ঠানিক ইবাদত ব্যতীত আরও ইবাদত রয়েছে। কোরআনে আল্লাহ্র ঘোষণা রয়েছে যে, সমগ্র মানব সমাজ আল্লাহ্র একটি পরিবার এবং যে ব্যক্তি এই পরিবারের একজন সদস্যের কল্যাণ করলো, সে যেন আল্লাহর প্রতি তার কর্তব্য পালন করলো। আল্লাহ্র নির্দেশ রয়েছে যেন পিতামাতার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা হয় এবং তাঁদের প্রতি কদাচ যেন কোন পীড়াদায়ক আচরণ না করা হয়। পিতামাতাসহ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন এবং আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এতিম, অভাবগ্রস্ত ইত্যকার সকলের প্রতি প্রয়োজনীয় সাহায্য করার জন্য কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ্ বারংবার নির্দেশ প্রদান করেছেন। অতএব অর্থোপার্জন, খাদ্যশস্য ও ফলাদি উৎপাদন, বৃক্ষ রোপণ, পানি সরবরাহের জন্য পুকুর খনন প্রভৃতি কল্যাণকর কার্যাদি করার তাগিদও ইসলামে রয়েছে। আপনার কৃষিক্ষেত থেকে শস্যদানা, বৃক্ষ থেকে ফলমূল, পুকুর থেকে পানি পান করে পশুপাখীসহ সৃষ্টজীব জীবন ধারণ করবে এবং আপনার এসব হিতকর কর্ম আল্লাহর নিকট সদকা বা দানকার্য বলে বিবেচিত হবে। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো সামাজিক কর্মকাণ্ড বলে দৃশ্যমান হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সবই ইবাদত। যে কাজ আল্লাহর নির্দেশে করা হয় তা-ই-ইবাদত। এসব অনানুষ্ঠানিক ইবাদত এবং আনুষ্ঠানিক ইবাদত একত্রে মিলেই পরিপূর্ণ ইবাদত। এ দু’য়ের যে কোন একটি পূর্ণাঙ্গ ইবাদত নয় এবং যে কোন একটি দ্বারা পরকালে পার পাওয়া যাবে না। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ এবং তাকে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন সম্পর্কে অবশ্যই পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। জীবন সংগ্রামে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং কঠোর পরিশ্রমের একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্তের অবতারণা এখানে প্রণিধানযোগ্য। বিষয়: বদরযুদ্ধ। অদম্য সাহস এবং প্রাণপণ সংগ্রামই যে সকল অর্জনের চাবিকাঠি, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বদরযুদ্ধ। বদরের ঊষর মরুপ্রান্তরে পৌত্তলিকদের ১০০০ সৈন্যকে মোকাবিলা করা মুসলমানদের অদক্ষ অপ্রশিক্ষিত মাত্র ৩১৩ জন লোকের পক্ষে যে অসম্ভব একথা ভেবে রাসুল (সা:) সিজদায় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ্, এই অসম যুদ্ধে আপনার সাহায্য না পেলে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো এবং আমরা নিশ্চিহ্ন হলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার জন্য কোন মুসলমান জীবিত থাকবে না।’ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ্ নির্দেশ প্রদান করলেন, ‘ইসলাম রক্ষা করা করা আপনার দায়িত্ব। আপনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হোন। আপনার অনুসারী মুমিনদেরও একাজে উদ্বুদ্ধ করুন’ (৮:৮৪)। যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ব্যতীত আর কোন বিকল্প রইল না। এই স্বল্প সংখ্যক লোক নিয়েই রাসুল (সা.) যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রাণপণ যুদ্ধ করে মুসলমানরা জয়লাভ করলো। মুসলিম রাষ্ট্র এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলো। পরাজয়ের গ্লানি ও অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে শত্রুরা পরবর্তীতে বার বার মুসলমানদের আক্রমণ করেছে, কিন্তু প্রতিবারই পরাভূত হয়েছে। সমাজে ইসলাম আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই সফলতা শুধু উদ্যমী প্রয়াস এবং কঠোর পরিশ্রম দ্বারাই অর্জিত হয়েছে; নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘরে বসে কোন দোয়ার দ্বারা অর্জিত হয়নি। ইসলাম শুধু একটি ধর্ম বিশ্বাস নয় এবং জায়নামাজে আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি কর্মমুখর পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। জীবনের জন্য ধর্ম। জীবন শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের জন্য নয়।

Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template