السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

ইসলামের দৃষ্টিতে সৌজন্যবোধ-এম. আব্দুর রব

| comments

মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি- আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ কেবল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠই নয়, সে পৃথিবীতে স্রষ্টার খলিফা বা প্রতিনিধি। কুরআন মজীদে বর্ণিত হয়েছে, মানব সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের বলেছিলেন, “ইন্নী জায়েলুন ফিল আরদে খলিফা”- আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠিত করব।


সে সৃষ্টি স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করবে, সে সৃষ্টিকে নিশ্চয়ই অন্যসব সৃষ্টির তুলনায় অধিক প্রাজ্ঞ ও শিষ্ট হতে হবে এবং হয়েছেও তা-ই। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, কৃষ্টি ও শালীনতার মাপকাঠিতে মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের তুলনা কেবল মানুষ।


শিষ্ট মানে আদব-কায়দা, শান্ত, নম্র, ভদ্র, সভ্য, মার্জিত, সুশীল, সুরুচি, সুনীতি, সুরীতি, সুশৃঙ্খল, সুসংস্কৃত, উৎকর্ষ, সদাচার, সদগুণ, সহজ, সরল, শুদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ, নিপুণ, নিষ্পাপ, পরিশুদ্ধ, মনোমুগ্ধকর, সৌন্দর্য, মাধুর্য, নীতি, নৈতিকতা, কৃষ্টি, বিনয়, সজ্জন, অভিজাত, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, শালীন, সহনশীল, সুন্দর, শোভন, প্রীতিপদ, ধর্মপরায়ণ ইত্যাদি। আর সৌজন্য হচ্ছে জীবনে এসব গুণের ব্যবহার। ভদ্র, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, মার্জিত, সুরুচি, সৎ, সজ্জন ও নীতিবান লোকের কথাবার্তা, চালচলন, আচার-ব্যবহারকে বলা হয় সৌজন্য বা শিষ্টাচার। সৌজন্য উন্নত রুচি, পরিচ্ছন্ন মনোভাব, পরিমার্জিত চিন্তাধারা, মনোমুগ্ধকর ব্যবহার, সহনশীলতা এবং নীতি ও নৈতিকতার মূর্ত প্রকাশ। সৌজন্য কেউ মাতৃগর্ভ থেকে শিখে আসে না। বিদ্যা-বুদ্ধির মতো কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে অর্জন করতে হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও এর আচার-অনুষ্ঠান- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, মানুষের স্বভাব ও চরিত্র গঠনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।


মানবসমাজকে সুন্দর, শোভন, প্রীতিপদ, পরোপকারী, সুশৃঙ্খল, সুসংস্কৃত, সভ্য, ভব্য, সুরুচিকর, সজ্জন ও মানবীয় করার জন্য শিষ্টাচারের অনুশীলন আবশ্যক। যিনি দয়ালু, মায়া-মমতার অধিকারী, পরোপকারী, কল্যাণকামী, ত্যাগী, নিষ্ঠাবান, সদাচারী, পরিশুদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ, ঐকান্তিক, নীতিবান ও ধর্মপরায়ণ তিনি স্বভাবতই সুজচন ও শিষ্ট। যিনি মহৎ, উদার, বিনয়ী, শান্ত, সাবধানী, পরহেজগার, সৎ- সর্বোপরি মানুষকে ভালবাসেন, তিনি মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী সুশীল ও সুজন। ব্যক্তিগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত সৌজন্য ও শিষ্টাচারের রেওয়াজ বা প্রচলন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়, পার্থিব শ্রীবৃদ্ধি আনয়ন করে।


দুনিয়ার জীবনে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বিত্ত-বৈভবের দরকার। অর্থ ছাড়া যেমন বেঁচে থাকা যায় না, তেমনি মানব কল্যাণেও কোন ভূমিকা রাখা যায় না। আর অর্থ উপার্জনের পথ হচ্ছে- কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকুরী ও অন্যান্য পেশা। সদাচার ও সৌজন্য ব্যতীত এর কোনটাই করা সম্ভব নয়। একজন শিল্প মালিককে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকলের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হয়, তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সচেষ্ট থাকতে হয়, ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিতে হয়। তা না হলে তাদের কাছ থেকে পুরোপুরি কাজ আদায় করা যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মচারীকে ধরে রাখা যায় না। একই কথা কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী ও অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মালিককে যেমন সহনশীল ও উদার হতে হয়, তেমনি কর্মচারীকে সৎ, নিষ্ঠাবান, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান হতে হয়।


প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে। কেবল অর্থনৈতিক নয়, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে। একজন ব্যবসায়ীকে অধিক গ্রাহক পেতে হলে তাকে যেমন সৎ হতে হয়, পণ্যসামগ্রী মানসম্পন্ন হতে হয়, তেমনি তাকে নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী হতে হয়। আর এর মাধ্যমেই সুনাম বা Good will রিষষ অর্জিত হয়। তা হলেই দিনে দিনে তার ব্যবসায় উন্নতি ঘটে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-সহ অনেক নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কিরাম ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। সততা, নম্রতা, উদারতা ও পরিশ্রমের দ্বারা তাঁরা সফলতা লাভ করেছেন।
ধর্ম প্রচারেও যে তাঁরা সফলতা লাভ করেছেন তাতেও রয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবহার, আচার-আচরণে মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব ও শিষ্টাচারের অসামান্য অবদান। সৌজন্য শত্রুকে মিত্র করে, প্রতিপক্ষকে স্বপক্ষে আনে এবং সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট হয়। ভদ্রতা ও সৌজন্য প্রদর্শনে কোন ব্যয় নেই অথচ লাভ প্রচুর। শিষ্টাচার আশীর্বাদস্বরূপ। আর অশিষ্টাচার অভিশাপস্বরূপ। শিষ্টাচার দুনিয়াতে প্রশংসা, অর্থ ও সচ্ছলতা আনে, আর আখিরাতে জান্নাত লাভে সহায়তা করে। অপরদিকে দুর্বৃত্তপরায়ণতা ও দুরাচার দুনিয়াতে যেমনি তিরস্কার, দুর্নাম ও অর্থকষ্ট ডেকে আনে, তেমনি আখিরাতে জাহান্নামের পথ প্রশস্ত করে।


ব্যক্তিগত শিষ্টাচারের দ্বারা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের যে অভিব্যক্তি ঘটে, যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তা কেবল তাকেই প্রকাশ করে না, তার পরিবার, তার সমাজ, তার দেশ এবং তার ধর্মকেও তুলে ধরে। শিষ্টাচার যেমন একজন ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করে, তেমনি একজন ব্যক্তির দুর্ব্যবহার ও দুরাচার তার পরিবার, সমাজ, দেশ, ধর্ম ও সংস্কৃতির দুর্নাম বাড়ায়। তাই শিষ্টাচার মানবজীবনের অন্যতম প্রধান গুণ। জীবনে যাঁরা উন্নতি করেছেন, সফলতা লাভ করেছেন, মহৎ হয়েছেন, প্রসিদ্ধি পেয়েছেন, তাঁরা সকলেই শিষ্টাচার ও শালীনতা বোধের চর্চা করেছেন। জাতি ও সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।


মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও তাঁর সাহাবীরা যে মানবসমাজে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তা কেবল তাঁদের সৌজন্য ও শিষ্টাচারের কারণে। আর স্বল্প সময় অর্থাৎ একশ বছরের ব্যবধানে ইসলাম যে সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে তার পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিলো সে সময়ের মুসলমানদের অমায়িক ব্যবহার, তাদের সরলতা, সহনশীলতা, উদারতা, ন্যায়বিচার, সাম্য ও ইসলামের সার্বিক সৌন্দর্য।


বর্তমানে মুসলিমরা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। অনেকেই সাময়িক লাভের মোহে শিষ্টাচারের বদলে দুর্বৃত্তপরায়ণতা ও দুরাচারের অনুশীলন করছে। একজন মুসলিমের আচার-আচরণ ও ব্যবহার দেখে এখন আর কোন অমুসলিম ইসলামের প্রতি আগের মতো আকৃষ্ট হচ্ছে না।


মানুষের, বিশেষ করে অধীনস্থদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করা উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা ও শিক্ষা লাভের জন্য হযরত হাসান (রা:) থেকে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। তিনি বলেন, “আমি আমার পিতা [হযরত আলী (রা:)]-কে নবী করীম (সা:)-এর গৃহাভ্যন্তরের কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বললেন, যখন ইচ্ছা করতেন তখনই নবী (সা:) গৃহে প্রবেশ করতেন। তিনি তাঁর গৃহের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করতেন। এক ভাগ আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতের জন্য, এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য, এক ভাগ নিজের বিশ্রামের জন্য। আবার নিজ বিশ্রামের সময় থেকে কিছু সময় লোকজনকে দিতেন। আর তা এইভাবে যে, ঐ সময় বিশেষ বিশেষ সাহাবী আসতেন এবং তাঁর কাছ থেকে দীনি বিষয়াদি জেনে নিয়ে সাধারণ লোকদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তাদের নিকট তিনি কোন কথাই গোপন রাখতেন না, সব কথাই বলে দিতেন। আর সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষাৎপ্রার্থীর দীনী মর্যাদা হিসেবে তারতম্য ঘটতো। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কারো থাকতো একটি কাজ, কারো দু’টি, কারো আরো বেশি। তিনি তাদের কাজে লেগে যেতেন এবং তাদেরকেও মশগুল রাখতেন। তাতে তাদের এবং উম্মতের সংশোধন হতো। তিনি তাদের সমস্যাবলী জানতে চাইতেন এবং যথাযথ পরামর্শ দিতেন এবং বলে দিতেন, যারা এখানে উপস্থিত আছ, তারা তা অনুপস্থিতদেরকে পৌঁছে দেবে। তিনি বলতেন, আমাকে সেই ব্যক্তির প্রয়োজন অবগত করো, যে তার প্রয়োজনকে আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। যে ব্যক্তি শাসকের কাছে এমন ব্যক্তির প্রয়োজন পৌঁছে দিয়েছে, যে তার নিজের প্রয়োজন শাসক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা ঐ ব্যক্তির দু’পা দৃঢ় রাখবেন। এসব ছাড়া তিনি কারো কোন কথা পছন্দ করতেন না।


হযরত হাসান (রা:) বলেন, অতঃপর আমি আমার পিতাকে নবী করীম (সা:)-এর বাইরের কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা:) অনর্থক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতেন। মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতেন, পৃথক হতে দিতেন না। প্রতিটি গোত্র বা কওমের সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করতেন এবং তাদের নেতা বা অভিভাবক বানাতেন। তিনি মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতেন। কিন্তু আন্তরিকতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তারতম্য করতেন না। নিজের সঙ্গী-সাথীদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং মানুষের হাল অবস্থা জানতে চাইতেন। ভালকে ভাল বলতেন এবং এর প্রশংসা করতেন। মন্দকে মন্দ বলতেন এবং এর নিন্দা করতেন। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অটল, প্রতিটি কাজ-কর্মে ছিলেন ভারসাম্যপূর্ণ, এদিক-সেদিক ঝুঁকে পড়তেন না। তিনি মানুষের প্রতি সব সময় খেয়াল রাখতেন, যাতে তারা অমনোযোগী কিংবা বিরক্ত না হয়ে পড়ে।
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template