[লেখকঃ সাবেক সচিব, গবেষক ও গ্রন্থকার]
মানবজাতির পিতা ছিলেন হযরত আদম (আ.)। আল কুরআনে মুসলমানদের বলা হয়েছে ‘মিল্লাতে ইব্রাহীম’ অর্থাৎ ইব্রাহীমের জাতি এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে বলা হয়েছে এ জাতির পিতা। (আল-কুরআন ২২:৮, ২:১৩০)।
সমাজের সর্বপ্রথম স্তর হলো পরিবার। সমাজ বহুসংখ্যক পরিবারের সমষ্টি। মুসলিম জাতির পরিবারের বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপ কেমন হবে তারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন এ জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)।
আদর্শের মিল না থাকলে, রক্ত ও বৈবাহিক সম্পর্ক থাকলেই পরিবারে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। হযরত নূহ (আ.)-এর বিবাহিত স্ত্রী এবং ঔরসজাত পুত্রও বিশ্বাস ও আদর্শের পার্থক্যের জন্যে মহাপ্লাবনের সময় ত্রাণকারী কিস্তিতে স্থান পায়নি।
মৌলিক আদর্শ সম্পর্কে মতভেদ বা মতদ্বৈতা থাকলে ঔরসজাত সন্তান এবং বিবাহিত স্ত্রী নিয়েও কোন আদর্শনিষ্ঠ পরিবার সংগঠিত হতে পারে না। মুসলিম পরিবারের সদস্যবৃন্দ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হন আদর্শ ও বিশ্বাসের বন্ধনীতে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্ত্রী হাজেরাকে (আ.) নির্বাসন দিয়েছিলেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজটি মনে হবে নিষ্ঠুর ও অমানবিক। কিন্তু কেন করেছেন? তা করেছেন কেবল আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্যেই। স্ত্রী হাজেরা (আ.) যখন শুনলেন যে আল্লাহর ইচ্ছা তিনি নির্বাসিত হোন, তিনি কোন প্রতিবাদ করলেন না। কারণ যে আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহীম (আ.) নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও গভীর বেদনা নিয়ে পতœীকে নির্বাসন দিচ্ছেন সে আল্লাহকে বিবি হাজেরাও তত গভীরভাবেই ভালবাসতেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। সন্দেহেরও কোন অবকাশ ছিল না তাতে।
বিবি হাজেরার নিকট ইসমাইলকে কুরবানী দেয়ার খবরটি কেমন লেগেছিল। তা অনুমান করা যেতে পারে। একটিমাত্র সন্তান। কত কষ্টে মা একে মানুষ করেছেন। সে সন্তান এখনো বালক। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ইচ্ছার প্রতিবাদ করলেন না তিনি। বললেন না যে, এ পুত্রকে তো তুমি পূর্বেই নির্বাসন দিয়েছো। কত কষ্টে আমি একে সহায়হীন অবস্থায় পালন করেছি। তার উপর তোমার কিসের অধিকার? কোন্ অধিকারে আমার পুত্রের গলায় তোমার প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্যে ছুরি চালাতে চাইছ?
মা হাজেরা তা তো বললেনই না, তিনি স্বেচ্ছায় পুত্রকে সাজিয়ে দিলেন। এ কুরবানী পিতা ইব্রাহীমের জন্যে যতটা কষ্টকর ছিল, মা হাজেরার জন্যে ছিল তার লক্ষগুণ বেশি বেদনাদায়ক। কোথা থেকে তিনি এত বিরাট আত্মত্যাগের শক্তি পেলেন? কেন তিনি স্বামীর সঙ্গে দ্বিমত হলেন না?
বর্তমানে অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারে স্বামী যদি বিপন্ন গরীব আত্মীয়কে কিছু দান করতে অথবা সাহায্য করতে চান- দেখা যায় অনেক প্রিয় পতœীর সুন্দর মুখখানা অমনি মলিন হয়ে ওঠে। বিবি হাজেরা (আ.) পুত্র কুরবানী দেয়ার ব্যাপারেও স্বামীর সঙ্গে আনন্দচিত্তে একমত হতে পারলেন। কিন্তু আমরা তো অনেক সময় অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগেও পরস্পর একমত হতে পারি না।
পুত্র ইসমাইলকে যখন পিতা ইব্রাহীম (আ.) তার প্রতিপালকের নির্দেশের কথা জানালেন তখন তার প্রতিক্রিয়া কি ছিল? বালক ইসমাইলও দ্বিধাহীন চিত্তে পিতার কর্তব্য পালনে নিজেকে কুরবানী দিতে এগিয়ে এলেন।
ইব্রাহীম ও হাজেরার কুরবানী ছিলো পুত্রের জান আর ইসমাইলের কুরবানী ছিল তার নিজের জীবন।
এ কুরবানী একদিন দু’দিনের জন্য নয়, সারাটি জীবনের জন্য। এ কুরবানী যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তেজনার বশে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় ছিলো এ কুরবানীর ইচ্ছা। এটা ছিলো মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কুরবানী।
বর্তমান মুসলিম পরিবারে কখনো কখনো পিতা তার কন্যার স্কুল অথবা কলেজ থেকে যথাসময়ে ফিরে না আসার কারণে খোঁজ নেয়ার জন্যে পুত্রকে পাঠাতে গলদঘর্ম হন। কারণ, পিতার কথায় কান দেয়ার সময় পুত্রের নেই।
হযরত ইব্রাহীমের পরিবার সারা মুসলিম উম্মার জন্যে আদর্শ পরিবার। এ পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যেই হজ্ব ও কুরবানীর অনুষ্ঠান।
যারা হজ্বে যান তারা কি কারণে যান? হজ্বের অধিকাংশ অনুষ্ঠানই হযরত ইব্রাহীম, ইসমাইল ও বিবি হাজেরার জীবনের ঘটনার অভিনয়। কাবার চারদিক তাওয়াফ করা, সাফা মারওয়ায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করা, মিনায় শয়তানকে কাঁকর মারা ইত্যাদির মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বিবি হাজেরা (আ.) এবং ইসমাইল (আ.)-এর আদর্শ মূল্যবোধ আমাদের নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার নিয়তই থাকা উচিত। পশু কুরবানীর যে অনুষ্ঠান আমরা পালন করি তার আসল মর্মবাণী যদি আমাদের হৃদয়ে না পৌঁছে, বিবি হাজেরা ও ইসমাইল যে অনুভূতি নিয়ে কুরবানীর জন্যে তৈরি হয়েছিলেন, তাদের সেই আদর্শ ও মূল্যবোধ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা ও দৃঢ় সংকল্প না নিয়ে যদি একটি নিরীহ মূক পশু কুরবানী করা হয়, তবে তা হবে পন্ডশ্রম।
জিলহজ্ব মাস, হজ্ব এবং কুরবানী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম পরিবারে মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিত। যে পরিবারে পিতা, পুত্র, মাতা, কন্যার মূল্যবোধের মধ্যে মিল এবং সমন্বয় নেই, সে পরিবার হতে পারে ইসলামী আদর্শচ্যুত পরিবার।
মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল-কুরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহীমের আদর্শেরই তাত্ত্বিক ও বাস্তব রূপ। মুসলিম পরিবারের জন্যে হজ্ব নিছক ভ্রমণ বা সফর নয়। কুরবানীর গোশত ভোজ উৎসব নয়। আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির উৎসব। একমাত্র তাৎপর্য নয়।
Post a Comment