আবু উমামা বাহেলী (রা.) বলেন, রাসুলে পাক (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন কারণে ক্রোধান্বিত হয়ে ক্রোধানুরূপ কিছু করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও সংযম অবলম্বন করে, রোজ কিয়ামতে আল্লাহ তার উপর অধিক সন্তুষ্ট হবেন।
ইঞ্জীল গ্রন্থে আছে, হে আদম সন্তান! ক্রোধ এসে গেলে আমাকে স্মরণ কর। তাহলে তোমার প্রতি আমার ক্রোধ এলে আমিও তোমাকে স্মরণ করব। আমার সাহায্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাক। কেননা তোমার জন্য আমার সাহায্য তোমার সাহায্যের তুলনায় শ্রেয়:
হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয এক শরাবখোরকে শাস্তি দেয়ার জন্য আটক করলেন। শরাবখোর তাকে নানারূপ গালিমন্দ শুরু করল। অমনি সাথে সাথে তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আমীরুল মু’মিনীন! সে এরূপ স্পর্ধা দেখানোর পরও আপনি তাকে মুক্তি দিলেন? তিনি বললেন, লোকটির ওরূপ ব্যবহারে আমার মধ্যে জাতক্রোধ ও আক্রোশের সঞ্চার হয়েছিল। তদবস্থায় তাকে শাস্তি দিলে তা আমার নিজের জন্য হত। অথচ ব্যক্তিগত আক্রোশবশত কোন মুসলমানকে শাস্তি দেয়া আমার কাছে অপছন্দনীয়।
মায়মুন বিন মেহরান (রহ.)-এর এক দাসীর হাত থেকে তার কাপড়ে তরকারীর ঝোল পড়ে গেল। তিনি ক্রোধে অধির হয়ে দাসীকে সাজা দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে দাসী কুরআনে পাকের ‘ওয়াল কাজেমীনাল গাইজা’ (ক্রোধ হজমকারীগণ) আয়াতাংশ পাঠ করল। তা শোনামাত্র মায়মুনের ক্রোধ দূর হয়ে গেল। দাসী তখন একটু সাহস করে আয়াতের পরবর্তী অংশও পাঠ করল। যথা: ‘ওয়াল আফীনা আনিন্নাস’ (এবং মানুষকে ক্ষমাকারীগণ) তা শুনে মায়মুন বললেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম। এবার দাসী আরো সাহসের বশে আয়াতের শেষাংশও পাঠ করল। যথা: ‘ওয়াল্লাহু ইউহিব্বুল মুহসিনীন’ (এহসানকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন)। তা শুনে এবার মায়মুন বললেন, যাও আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিলাম।
রাসুলে পাক (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তির মাঝে তিনটি গুণের অভাব সে ঈমানের স্বাদ লাভ করে না। যেমন- (১) সহিষ্ণুতা-এর দ্বারা অজ্ঞ ব্যক্তির অজ্ঞতা দূর হয়ে যায়। (২) পরহেজগারী- এর দ্বারা হারাম বা অবৈধ ব্যাপার থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
(৩) সচ্চরিত্র- এর মাধ্যমে মানুষের সাথে সদাচরণ প্রদর্শন করা যায়।
জনৈক জ্ঞানী একটি ঘোড়া ছিল। তিনি সেটিকে খুবই ভালবাসতেন। এটিকে তিনি তিন পায়ের উপর দাঁড়ানো দেখে খাদেমকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কাজ কে করেছে? খাদেম বলল, আমি। তিনি বললেন, কোন উদ্দেশ্যে? খাদেম বলল, আপনাকে রাগান্বিত করার উদ্দেশ্যে। (তখন জ্ঞানী ব্যক্তি আসল ব্যাপারটি বুঝতে পেরে) বললেন, ঠিক আছে, যে তোমাকে এই অপকর্মের পরামর্শ দিয়েছে এবার আমি তাকে রাগান্বিত করব। অর্থাৎ, শয়তানকে জব্দ করে দেব। যাও খাদেম, আজ থেকে তুমি মুক্ত এবং তুমি এ ঘোড়াটিকেও নিয়ে যাও।
বনী ইস্রাইলের এক বুযর্গকে বিপথগামী করার জন্য শয়তান বার বার চেষ্টা চালিয়েও সফল হতে পারেনি। একদিন ঐ বুযর্গ প্রয়োজনে কোথাও যাচ্ছিলেন, শয়তানও তার অনুসরণ করল। পথিমধ্যে তাকে রাগান্বিত বা কোন অসৎ কাজে লিপ্ত করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালাল। কখনো বা তাকে ভয় প্রদর্শন করল কিন্তু কোনভাবেই সে সফল হল না। একবার হযরত মূসা (আ.) এর কাছে ইবলীস এসে বলল, আপনি আল্লাহর মনোনীত রাসূল। এমনকি আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বলার মর্যাদালাভে ধন্য। আমি তাওবাহ করার ইচ্ছা করেছি। আপনি আল্লাহর দরবারে আমার তাওবাহ মকবুল হওয়ার জন্য সুপারিশ করুন।
হযরত মূসা (আ.) তার কথা শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেলেন। কেননা শয়তান তাওবাহ করে ফেললে মানুষের তো গুনাহ করার আর কোন প্রশ্নই থাকে না; সুতরাং হযরত মূসা (আ.) অজু করে নামায আদায় করতঃ দোয়ায় মগ্ন হলেন। আল্লাহ তাকে বললেন, হে মূসা! শয়তান মিথ্যা বলেছে। সে আপনাকে প্রতারিত করতে চাইছে। তাকে পরীক্ষা করার জন্য বলে দিন, সে যেন আদমের কবরে সিজদাহ করে। আমি তার তাওবাহ কবুল করব। হযরত মূসা (আ,) খুশি হয়ে ভাবলেন, এটা তো একটি সাধারণ শর্ত। শয়তান অবশ্যই মেনে নেবে। তাই তিনি শয়তানকে আল্লাহর এ প্রস্তাব শুনিয়ে দিলেন। শুনে ইবলীস উগ্রমূর্তি হয়ে গেল। সে বলল, জীবিত থাকাবস্থায় যাকে সিজদাহ করিনি, তার মৃত্যুর পর এখন তাকে সিজদাহ করব! (তা হতেই পারে না)। তবে হে মূসা! আপনি আমার জন্য যে সুপারিশ করেছেন এর শোকরিয়াস্বরূপ আমি আপনাকে তিনটি কথা জানিয়ে দিচ্ছি, কথাগুলো শুনে নিন।
(১) মানুষ যখন ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে তখন আমি তার অন্তরে ঢুকে পড়ে শিরায় শিরায় রক্তের ন্যায় দৌড়াতে থাকি। (২) আমি দ্বীনের দায়ীদের হৃদয়ে প্রবেশ করে তাদের স্ত্রী, পুত্র, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির চেষ্টায় লেগে যাই। যাতে সে নিবৃত থাকে। (৩) যখন কোন পুরুষ গায়রে মাহরাম রমণীর সাথে নির্জনে অবস্থান করে তখন আমি তাদের উভয়ের তরফ থেকে উকীলস্বরূপ একের মনকে অন্যের প্রতি ঝুঁকানোর চেষ্টায় তৎপর হয়ে যাই। আর যখন পর্যন্ত না তারা অসৎ কার্যে লিপ্ত হয় তখন পর্যন্ত এ তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকি।
হযরত লোকমান তার পুত্রকে বললেন, হে বৎস! তিনটি লোককে তিনটি সময় চিনতে পারা যায়ঃ
(১) ধৈর্যশীল: ক্রোধের উদ্রেক হলে চিনা যায় কে ধৈর্যশীল আর কে ধৈর্যশীল নয়। (২) বাহাদুরঃ যুদ্ধের সময় চেনা যায় কে বাহাদুর আর কে বাহাদুর নয়। (৩) বন্ধুঃ অভাব-অনটন ও বিপদকালে চেনা যায় কে বন্ধু আর কে বন্ধু নয়। রাসুলে পাক (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অত্যাচারীর প্রতি বদদোয়া করল, সে মুহাম্মদকে অসন্তুষ্ট করল এবং শয়তানকে সন্তুষ্ট করল। আর যে ব্যক্তি অত্যাচারীকে মার্জনা করল, সে মুহাম্মদকে খুশি করল আর অভিশপ্ত শয়তানকে নাখোশ করল।
একব্যক্তি আহনাফ বিন কায়েসকে জিজ্ঞেস করল, মনুষ্যত্বের পরিচয় কি? তিনি বললেন, ধন-সম্পদ ও সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা। প্রতিশোধ গ্রহণের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মার্জনা করা। মানুষকে খোটা না দিয়ে বরং সাহায্য-সহায়তা করা। কোন ব্যাপারে ক্রোধের উৎপত্তি হলে তখন তাড়াতাড়ি কিছু না করে ফেলে সহিষ্ণুতার আশ্রয় নেয়া। ধৈর্যের সাথে কাজ করার মাঝে তিনটি উপকার আর অস্থিরতার মাঝে কাজ করলে তিনটি ক্ষতি ঘটে।
ধৈর্যের সাথে কাজ করার তিনটি উপকার:
(১) ধৈর্য ধারণের ফলে খুশি ও আনন্দ লাভ হয়। (২) সবাই ধৈর্যশীলের প্রশংসা করে। (৩) ধৈর্যাবলম্বন করলে আল্লাহর তরফ থেকে উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়।
অধৈর্যের সাথে কাজ করার তিনটি অপকার:
(১) অধৈর্য ও অস্থিরতার সাথে কাজ করলে লজ্জা পেতে হয়। (২) অধৈর্য ও অস্থির ব্যক্তিকে সবাই ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে। (৩) অধৈর্য ও অস্থির ব্যক্তির উপর আল্লাহর তরফ থেকে শাস্তি পতিত হয়।
ধৈর্য ধারণ করার প্রথমাবস্থা তিক্ত ও ক্লেশকর হলেও শেষাবস্থা খুবই মধুর হয়।
Post a Comment