বিবি হাজেরা একটি নাম, একটি কাহিনী, একটি আল্লাহর অসীম কুদরত। তার সবচেয়ে বড় যে পরিচয় সেটা হল অসাধারণ অতুলনীয় মাতৃহৃদয়। মাতৃত্বের অহংকারে মহিমান্বিত এক নারী তিনি। তিনি হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর স্ত্রী ও হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর জননী। তিনি ছিলেন একাধারে নবীর স্ত্রী ও নবীর মাতা। এমন দুর্লভ মর্যাদা খুব কম নারীর ভাগ্যে জুটেছিল।
৮৬ বছর বয়স পর্যন্তও হযরত ইবরাহীম (আ:) নি:সন্তান অবস্থায় বসবাস করেন। তাঁর ছিল দুই স্ত্রী বিবি সারা, বিবি হাজেরা। প্রায় সাতাশি বছর বয়সে বিবি হাজেরার গর্ভে জন্ম নিলে পুত্র ইসমাঈল (আ:)। আল্লাহর নির্দেশ হযরত ইবরাহীম (আ:) স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বর্তমানে কাবা শরীফের সন্নিকটে রেখে ফিরে এলেন। স্ত্রী-পুত্রের জন্য এক মশক পানি ও থলেতে কিছু খেজুর। জনহীন অনাবাদী প্রান্তরে মায়ের বুকে শিশু পুত্র। বিদায়ের আগে শুধু জেনে নিলেন বিবি হাজেরা এমনটিই নাকি আল্লাহর হুকুম।
কয়েক দিন চললো বিবি হাজেরার থলে থেকে খেজুর ও মশক থেকে পানি খেয়ে আর শিশুটির মায়ের বুকের দুধ খেয়ে। কিন্তু একদিন নি:শেষ হল থলের খেজুর আর মশকের পানি। মাতৃদুগ্ধ ও নি:শেষ, ক্ষুধায় কাতর শিশু পুত্র ইসমাঈল। মায়ের কাছে এ দৃশ্য যে অভাবিত! পানির জন্য উৎকণ্ঠিতা মা হাজেরা নিকটবর্তী ‘সাফা” পাহাড়ে দৌড়ে গেলেন, নেই! সেখানে পানির অস্তিত্ব। সাফা থেকে দৌড়ে নেমে উঠলেন সামনে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের উপরে। নাহ্ এখানেও পানি নেই?
সাফা-মারওয়া পর্বতদ্বয়ের উপরে পানির আশায় দৌঁড়াদৌঁড়ি ও পানির অভাবে প্রাণান্ত শিশুর মুখ শেষবারের মত দেখা জননী হাজেরার পক্ষে কতখানি হৃদয় বিদারক ঘটনা ছিল তা সহজেই অনুমেয়। মায়ের মমতা, স্নেহ ও আবেগের সে মুহূর্তে বিবি হাজেরা নিজের দেহ ত্যাগের পূর্বাহ্নেও আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হলেন না। হঠাৎ পুত্রের চিৎকার ধ্বনি শুনে দৌড়ে কাছে চলে গেলেন। পাথরের বুক চিরে মহানন্দে গর্জন করে এক খরতর স্রোত প্রবাহমান। শিশু ইসমাঈলের পদতল হতে বের হচ্ছে। আল্লাহর কি অপার করুণা! তারপর তিনি নিকট থেকে পাথর দিয়ে চারিপার্শ্বে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে দিলেন।
বিবি হাজেরার সে মাতৃমমতাকে চিরতরে ধর্মানুরাগী মানুষের মনে চির জাগরুক রয়েছে। সাফা ও মারওয়ার উপরে নীচে দৌঁড়াদৌঁড়ি আজও বিবি হাজেরার সেই স্মৃতি হৃদয়বান মানুষের মনে এক অচিন্ত্যনীয় আবেগের সৃষ্টি করে।
সেই হতে হাজীদের প্রতি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাত বার দৌড়াদৌড়ি করা হজ্বের অংশ করা হয়েছে। এ কারণেই হাজীগণ হজ্বব্রত পালন করার সময় বিবি হাজেরাকে অনুকরণ করে সেই দুই পাহাড়ে সাত বার ছুটাছুটি করে থাকে।
এক সময় হযরত ইবরাহীম (আ:) মনস্থ করলেন, তিনি বিবি হাজেরা ও তাঁর ছেলেকে দেখতে যাবেন। এই কথা তিনি বিবি সারাকে জানালেন। বিবি সারা শুনে বললেন, “আপনি দেখতে যাবেন তার জন্য আমি আপনাকে নিষেধ করছিনা কিন্তু আমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেন যে যার উপর চড়ে যাবেন তার উপর হতে অবতরণ করতে পারবেন না।”
হযরত ইবরাহীম (আ:) যখন স্ত্রী-পুত্রকে দেখতে আসলেন তখন বিবি হাজেরা প্রিয় স্বামীকে অনেক দিন পর দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। উট থেকে স্বামীকে নামার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন হযরত ইবরাহীম (আ:) উট থেকে না নামার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। হাজেরা ব্যথিত হয়ে স্বামীর পদধূলি গ্রহণ করার জন্য দুই খানা পাথর এনে নবীর পায়ের তলে রেখে দিলেন। নবী সেই পাথরের উপর পা রাখলেন এবং উটের পিঠে থাকা অবস্থায় মাথাটা নীচু করলেন। সাথে সাথে বিবি হাজেরা তাঁর স্বামীর শির মোবারক ধৌত করে দিলেন। আজ পর্যন্ত সেই পাথর ও পায়ের নিশান বিদ্যমান আছে। সত্যিই অতুলনীয় স্বামীর প্রতি বিবি হাজেরার এই গভীর ভালবাসা।
এমনকি যখন আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ:) প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ:) কে আল্লাহর পথে কুরবানী করতে চাইলেন তখনও বিবি হাজেরা বাধা দিলেন না বরং নাড়ি ছেঁড়া ধনকে পরম আনন্দে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মাতৃত্বকে কুরবানী দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তিনি।
Post a Comment