আধ্যাত্মিক গুরু সুফি নেতা ও অতুলনীয় অনন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হুজুর (রহ.) [১৯৬৬ সালের নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই] কোন এক দিন তার বিন্যাফৈইর বাসভবনের পাশে অবস্থিত মসজিদের আঙিনায় ভক্ত মুরিদদের সমাবেশে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ভাষণে বলেছিলেন, ‘দুনিয়াবি কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, গর্ব-লোভ, মিথ্যা-অন্যায়, প্রতারণা ও রিয়ামুক্ত রাসূল (সা.) প্রেমিক আমিত্বহীন পবিত্র মানব হƒদয়ে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বাস। এমন হƒদয়ের অধিকারী নন এমন লোকের প্রার্থনা ও কোরবানি স্রষ্টার দরবারে গৃহীত নয়।’ পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মূল নির্যাস হচ্ছে : ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’Ñ অর্থাৎ ‘যিনি নিজেকে জেনেছেন তিনি তার প্রভু আল্লাহকে চিনেছেন’। নিজেকে না জেনে আল্লাহ-রাসূলকে (সা.) না চিনে আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে মাংস খাওয়া যায় সত্য, কিন্তু কোরবানি কি হয়?
আধ্যাÍিক গুরু সুফি নেতা মুর্শিদ মওলানা ভাসানী হুজুরের (রহ.) একজন ভক্ত প্রশ্ন করলেন, হুজুর কোরবানি তাহলে কিভাবে করতে হয়? ভক্তের কথার উত্তরে হুজুর ভাসানী (রহ.) বলতে লাগলেন : কোরবানি শুধু পশুর গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়াকে বোঝায় না। রাসূল (সা.) ও আল্লাহপ্রেমে নিজের ভেতরের ‘আমিত্ব’কে কেটে ফেলতে পারলেই সত্যিকারের কোরবানি হয়। এটাকেই বলে মরার আগে মরে যাওয়া।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘মুতু কাবলা আনতা মুতু’ অর্থাৎ ‘মরার আগে মরে যাও’। জীবিত থেকে আপন কামনা-বাসনা ও সব ধরনের ভোগস্পৃহাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছায় ত্যাগ করে পশু কোরবানি করলে সার্থক হয়, এটাই আল্লাহর বিধান, পবিত্র কোরআনের বাণী ও হাদিসের মূলকথা। নিজেকে আল্লাহ-রাসূল (সা.) প্রেমে উৎসর্গ করার কথা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নাফসের সঙ্গে জেহাদ করার কথা, দুস্থ, অসহায়, এতিম মানুষের সেবা করার কথা, মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কথা এবং জাগতিক ও আধ্যাÍিক অন্যান্য প্রতিটি কর্মক্রিয়া সম্পাদন করতে পবিত্র কোরআনে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই মিথ্যা, অন্যায়, ঘুষ, দুর্নীতি, হিংসা, বিদ্বেষ ও জাগতিক লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে একমাত্র আল্লাহ-রাসূলের (সা.) সন্তুষ্টির জন্য পশুর সঙ্গে নফসের কুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করতে বলা হয়েছে। আমরা কি তা পেরেছি? আপনারা কি তা পেরেছেন? মওলানা ভাসানী হুজুরের (রহ.) আধ্যাÍিক অনুসারীরা একযোগে বলে উঠলেনÑ না, না আমরা তা পারিনি। আপনি আমাদিগকে সাহায্য করুন আমরা যাতে আল্লাহ-রাসূল (সা.) প্রেমে সত্যিকারের কোরবানি দিতে পারি।
মুর্শিদ মওলানা সুফি নেতা হুজুর ভাসানী (রহ.) তার ভক্ত-অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন : মুসলিম জাহান ঈদুল আজহার কোরবানির মাধ্যমে আনন্দ-উল্লাসে জেগে উঠেছে। ঈদের মাঠে এক মুসলিম ভাই আর এক মুসলিম ভাইকে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ভাইদেরও জানিয়েছেন ঈদের শুভেচ্ছা। অসাম্প্রদায়িক এক মধুর মিলনে সবাই একাকার, ঈদের খুশিতে খুশি হয়েছেন। মানুষ মানুষে ভেদাভেদহীন এই যে ভালোবাসা, এই যে আল্লাহপ্রেম বা এই ঐশী মহব্বত মানবমনে ধারণ করলে দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, ঝগড়া-বিবাদের আর উদ্ভব হতো না, একজন আর একজনকে ঠকিয়ে ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলত না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে কুক্ষিগত করে রেখে অভাবগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্টকে আরও বাড়াত না। দেশের মধ্যে ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকত না। মুনাফাখোর দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে গরিব-মেহনতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলত না। অন্ধ, খঞ্জ, পঙ্গু, মূক, বধির, বৃদ্ধ, অচল ও ভিক্ষুকদের রাস্তাঘাটে দেখা যেত না। হাইজ্যাকার-সন্ত্রাসীরাও ভালো মানুষ হয়ে যেত।
ইসলামের সত্যিকার মূল্যবোধে উজ্জীবিত সাম্য, শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধের ঐক্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতো। কোন মুসলিমের চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা, জ্ঞান-বুদ্ধিমত্তা ও ক্রিয়াকর্ম অন্য কোন শান্তিপ্রিয় মানুষের অকল্যাণ সাধনে ব্যবহƒত হতো না। আÍদর্শনে সক্ষম নিঃস্বার্থ প্রেমে উজ্জীবিত এসব ব্যক্তি দেশে জাতি-সমাজের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করত। প্রতিটি মানুষের মাঝেই শুধু নয়, সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টিতে সেই মহান রাব্বুল আলামীনকে অনুভব করত। আর এই অনুভূতিই তাদের করে তুলতÑ ‘আলমুমেনু মিরাজুল মুমিনিন’ অর্থাৎ ‘একজন মোমেন আর একজন মোমেনের আয়নাস্বরূপ’। এ জন্যই তারা আল্লাহপ্রেমে বলে উঠতেনÑ ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। প্রিয়নবীর (সা.) প্রিয় সাহাবা (রা.) ও প্রিয় আশেকানরা এমন গুণেরই অধিকারী ছিলেন। মানবসেবা তাদের ব্রত ছিল। তাই যারা কোরবানির পশুর সঙ্গে আমিত্বকে কোরবান করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করতে পেরেছেন আল্লাহপ্রেমে তাঁর এশকে বিলীন হতে পেরেছেন তারাই ধন্য হয়েছেন।
হঠাৎ করে একজন ভক্ত মুরিদ দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন ‘হুজুর আল্লাহকে ভালোবাসব কিভাবে?’ সুফিনেতা মুর্শিদ মওলানা ভাসানী হুজুর (রহ.) তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন : মানুষকে ভালোবেসেই আল্লাহকে ভালোবাসতে হয়। পবিত্র কোরআনেও আছে : স্রষ্টাকে মান্য কর সৃষ্টিকে ভালোবাস। হাদিস শরিফে আছে হাশরের দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বলবেন : আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তোমরা আমকে খেতে দাওনি, আমি পিপাসার্ত ছিলাম তোমরা আমাকে পানি পান করাওনি, আমি অসুস্থ ছিলাম, তোমরা আমার সেবা করনি, আমি বিপদগ্রস্ত ছিলাম তোমরা আমাকে বিপদমুক্ত করনি। বান্দা আল্লাহকে বলবেন : আপনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সর্বজীবের রিজিকদাতা, সর্বজীবের লালনপালন কর্তা, রক্ষাকর্তা, আপনার সাহায্য ব্যতীত কারও উপায় নেই। আপনিই সবার ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণকারী, আপনাকে আমরা কিভাবে খাওয়াব, কেমন করে পানি পান করাব, কেমন করে সেবা করব, কেমন করেই বা সাহায্য করব? আল্লাহ বলবেন : ক্ষুধার্ত মানুষকে যদি খাওয়াতে, পিপাসিত মানুষকে যদি পানি দিতে, অসুস্থ মানুষকে যদি সেবা করতে, বিপদগ্রস্ত মানুষকে যদি সাহায্য করতে, তবে আজ তোমরা তা আমার কাছে পেতে। এ জন্যই আমাদের জীবনকে সর্বজীবের ভালোবাসায় উৎসর্গ করতে হবে।
মুর্শিদ মওলানা আধ্যাত্ম জগতের মহান সাধক সুফিনেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হুজুর (রহ.) তার ভক্ত-অনুসারীদের লক্ষ্য করে বলেন : প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দুটো ‘আমি’ রয়েছে। একটি হল ক্ষুদ্র ‘আমি’ আরেকটি বৃহৎ ‘আমি’। মানুষ ক্ষুদ্র আমিতে বন্দি হয়ে আছেÑ এটাকে যিনি বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ আমিতে পদার্পণ করতে পেরেছেন, তিনিই স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। তার হƒদয়ে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভালোমন্দ উদ্ভাসিত হয়েছে। সমগ্র মানবজাতির সুখ-দুঃখ তার হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছে। আর এ জন্যই তিনি সমগ্র মানবজাতি তথা সমগ্র সৃষ্টিজগতের কাজে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন।
Post a Comment