হজ একটি মহান আধ্যাত্মিক বিধান এবং ইসলামী ইবাদতগুলোর মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহ বা খানায়ে কাবা এবং বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী খাতামুন নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর পবিত্র রওজা মুবারক জিয়ারতের সাধ প্রতিটি মুসলমানেরই হৃদয়ে জাগে। হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা কোনো কিছুর সংকল্প করা। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা এবং কয়েকটি বিশেষ স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী জিয়ারত, তাওয়াফ, অবস্থান করা এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করা।
পবিত্র কোরআনে এই ইবাদত সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে_'আর আল্লাহর উদ্দেশে এ ঘরের হজ করা সেসব লোকের জন্য ফরজ, যে ওই পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু যে এটা অস্বীকার করে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ জগৎসমূহের মোটেও মুখাপেক্ষী নন।' (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭)। এ ইবাদত গরিব মুসলমানের জন্য ফরজ নয় এবং যার জানের নিরাপত্তা নেই তার ক্ষেত্রেও হজ ফরজ নয়। শুধু দৈহিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্যই এই ইবাদতকে ফরজ করা হয়েছে।
হজের গুরুত্ব যে কত ব্যাপক তা এই হাদিসের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়, যেমন_হজরত রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজব্রত পালন করে আর কোনো ধরনের অশালীন কথাবার্তা ও পাপকাজে লিপ্ত না থাকে সে যেন নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ অবস্থায় হজ থেকে ফিরে এলো।' (বোখারি ও মুসলিম)। এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অনেকেই পয়সার জোরে প্রতিবছর হজ সম্পাদন করেন আর প্রতিবছরের গুনাহ-খাতা মাফ করিয়ে আনেন। হজ পালন করলেই নিষ্পাপ হয়ে যাব, এমন এক অদ্ভুত মানসিকতাও আমাদের সমাজের অনেকের মাঝে বিরাজ করে। মহান আল্লাহ যাঁদের হজ করার সামর্থ্য দান করেছেন, তাঁদের উচিত কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই যেন উদ্দেশ্য হয় আর পূর্বের সব দোষ-ত্রুটির ক্ষমা চেয়ে মুমিন-মুত্তাকি হয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। আর যদি এমনটি হয় যে হজ থেকে ফিরে এসে আগের মতোই জীবন পরিচালিত করতে থাকে, তাহলে তার হজ করা আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য রাখে না।
অনেকে এমনও রয়েছেন, যাঁরা একাধিকবার হজ করেন আর কয়েকবার হজ করা সত্ত্বেও তাঁর মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। নিজের মাঝে যদি পবিত্র পরিবর্তনই না আসে, তাহলে এ হজ বৃথা। আমার পাশের ঘরের মানুষ না খেয়ে রাত যাপন করবে আর আমি হজ করতে যাব_এ ধরনের হজকারীর কোনো মূল্য নেই আল্লাহর দরবারে। এ ছাড়া যাঁরা একবার হজ করেছেন, তাঁরা ইচ্ছা করলে অন্য কাউকে হজ পালন করার সুযোগ করে দিতে পারেন, ফলে দুইজনই পুণ্য লাভ করতে পারেন।
ইতিমধ্যে আমাদের দেশ থেকে হজে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে, আরো যাঁরা হজে যেতে চান তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য নিম্নে উপস্থাপন করছি।
হজে যাওয়ার সময় অবশ্যই ভালো জামাকাপড় নেবেন। জুতা, স্যান্ডেল, ব্রাশ, টুপি, হাতব্যাগ, বেল্ট_যা না হলেই নয় তা সঙ্গে নেবেন। সুই-সুতা, সেফটি পিন, রেজর, কাঁচি, ব্লেড, ঘড়ি, কলম, কাগজ, নোটবুক, মোবাইল, চার্জার, নেইল কাটার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস লাগেজ এবং হ্যান্ডব্যাগে রাখবেন। মনে রাখবেন, বোঝা যত ছোট রাখা যায় ততই ভালো। হাজিদের প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসই মক্কা ও মদিনা শরিফে পাওয়া যাবে, তবে দাম একটু বেশি হবে।
যাওয়ার আগে সঙ্গী নির্বাচন করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশে অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা কোনো অসুবিধা হলে সঙ্গের লোকেরা সহযোগিতা করে থাকেন। এমনিতেও কমপক্ষে তিনজনের একটি ঘনিষ্ঠ দল থাকা ভালো। ভিড়ে হারিয়ে গেলে অথবা পথ হারিয়ে ফেললে বা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে তিনজনের পারস্পরিক সহযোগিতায় অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। অবশ্যই একজনকে আমিরে কাফেলা নির্বাচন করবেন। তাঁর আদেশ-নিষেধকে মেনে চলার চেষ্টা করবেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। পাসপোর্ট বা হজ পাসের ফটোকপি এবং প্রয়োজনীয় দেশি-বিদেশি টেলিফোন নম্বর দুটি পৃথক স্থানে রাখা উচিত। যাঁরা চশমা ব্যবহার করেন, তাঁদের দুই জোড়া চশমা রাখা উচিত। জরুরি ওষুধ যেমন_হার্টব্যাধি, ডায়াবেটিস, প্রেশার ইত্যাদির ওষুধ দুটি ভিন্ন জায়গায় রাখা দরকার, তবে হাতের কাছে রাখবেন, যাতে সহজেই পাওয়া যায়।
যাঁরা পবিত্র হজব্রত পালন করতে যাচ্ছেন, তাঁরা অবশ্যই পানি বেশি পান করবেন, তবে মনে রাখবেন_খাবার বেশি খাবেন না, যতটুকু খেলে চলে ততটুকুই খাবেন। আপনি যদি হজের দিনগুলোতে খুব বেশি খাবার খান, তাহলে আপনার ইবাদতে কষ্ট হবে। রোদের জন্য ছাতা ব্যবহার করতে পারেন। তাই ছোট একটি ছাতা সঙ্গে নিয়ে গেলেই ভালো হয়। যদি কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে ভয় না পেয়ে হাজিদের জন্য যে চিকিৎসা ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে যাবেন। তাঁরা আপনার ভালো চিকিৎসা করবেন।
মহিলা হাজিদেরও হজব্রত পালন করতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে যেসব মহিলা হজে যাচ্ছেন, তাঁরা একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখবেন_তা হলো আপনার ক্যাম্প থেকে বের হয়ে কোথাও একা একা যাবেন না। এতে হয়তো আপনি রাস্তা ভুলে গেছেন, ক্যাম্পে ফেরত আসাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তাই কোথাও যেতে হলে যাঁর সঙ্গে হজে যাচ্ছেন, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
সঠিকভাবে হজের নিয়ম-কানুন পালন করে হজ সম্পন্ন করার জন্য শক্তিরও প্রয়োজন রয়েছে। দেখা যায়, সব কিছু পরিপূর্ণভাবে করতে বৃদ্ধদের জন্য অনেক কষ্টকর। এ ছাড়া আফ্রিকান হাজিরা যখন দলবেঁধে শয়তানকে পাথর মারতে যান বা হাঁটাচলা করেন, তখন পাশে কে আছে তা তাঁরা খেয়ালই করেন না, ফলে অনেক সময় বৃদ্ধ হাজিরা মাটিতে পড়ে যান এবং এ কারণে মৃত্যুবরণও করতে হয়। যাঁরা হজ করেছেন, তাঁদের অনেকেরই মত_৫০ বছর বয়সের মধ্যেই হজ সম্পন্ন করা উচিত। আমরা দেখি যে বাংলাদেশের অধিকাংশ হাজি জীবনের শেষদিকে হজ করতে যান, এটা কিন্তু তাঁদের জন্য কষ্টকর। শুনেছি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোকেরা যৌবনেই হজ করাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক নিয়তে সুন্দর ও সুস্থমতো হজ পালন করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
লেখক: মাহমুদ আহমদ সুমন, ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট
Post a Comment