হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো জিয়ারতের ইচ্ছা বা সংকল্প করা। আর পরিভাষায় হজ বলা হয়, আল্লাহ মহানের সন্তুষ্টির জন্য শরিয়তের বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা শরিফসহ সংশ্লিষ্ট স্থানগুলো পরিদর্শন করাকে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হজ। সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা ফরজ।
পবিত্র হজের দিনভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম থাকে এবং সেসব কাজকে নিয়মমাফিক সঠিকভাবে আদায় করতে হয়। নিম্নে দিনভিত্তিক হজের কার্যাবলি তুলে ধরা হলো।
প্রথম দিন (৮ জিলহজ) : এই দিন হাজিরা নিজ নিজ স্থান বা মিকাত থেকে হজের জন্য ইহরাম বাঁধবেন এবং হজের নিয়ত করে তালবিয়া [লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...] পাঠ করবেন। জোহরের নামাজের আগেই মিনায় রওনা হবেন। মিনায় গিয়ে জোহরের নামাজ আদায় করবেন এবং পরদিন ফজরের নামাজ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করবেন। মিনায় অবস্থান করাটা সুন্নাত। আর না করা মাকরুহ।
দ্বিতীয় দিন (৯ জিলহজ) : এই দিন সূর্যোদয়ের পর 'আরাফা'র উদ্দেশে হাজিরা রওনা দেবেন। পেঁৗছার পর সেখানে অবস্থান করবেন এবং সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা প্রত্যেক হাজির জন্য ফরজ। কেউ যদি এ সময়ে আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে সক্ষম না হন, তবে তিনি ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে অবস্থান করতে পারলেও ফরজ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু ৯ জিলহজ রাতেও যদি কেউ আরাফার ময়দানে পেঁৗছতে না পারেন, তবে তাঁর সে বছরের হজ বাতিল বলে গণ্য হবে। আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে বেশি বেশি দোয়া-মোনাজাত করা সুন্নাত। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরাফার ময়দান থেকে 'মুজদালিফা'র দিকে রওনা হবেন এবং সেখানে পেঁৗছে একসঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমে মাগরিব ও পরে এশার নামাজ আদায় করতে হবে। এ নামাজ আদায়ের জন্য জামায়াত শর্ত নয়, একা একাও আদায় করা যেতে পারে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী মুজদালিফা দোয়া কবুল হওয়ার স্থান, তাই এখানে অবস্থানকালে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে এবং পরবর্তী ফজরের নামাজ পর্যন্ত এখানে অবস্থান করতে হবে। মুজদালিফার 'ওয়াদিয়ে মুহাসসাব' ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় অবস্থান করা যাবে।
তৃতীয় দিন (১০ জিলহজ) : এই দিন সূর্যোদয়ের পর মুজদালিফা থেকে মিনার দিকে রওনা হবেন। মিনায় পেঁৗছার পর প্রত্যেক হাজিকে বেশ কয়টি কাজ করতে হবে, যেমন_
১. জামরায়ে আকাবায় পাথর নিক্ষেপ : এখানে মোট সাতটি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। ১০ জিলহজ ভোর থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপ করা যাবে। পাথর নিক্ষেপ করার সময় তালবিয়া পাঠ করা বন্ধ রাখতে হবে। এই সময়ের মধ্যে কোনো হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে না পারলে পরে তা আদায় করে নেবেন। জামরা বা পাথর নিক্ষেপের স্থান মোট তিনটি। মসজিদে খায়েফের নিকটবর্তী জামরাকে 'জামরায়ে উলা বা প্রথম জামরা' বলা হয়। এর পরবর্তী জামরাকে 'জামরায়ে উসতা বা মধ্যবর্তী জামরা' এবং তৃতীয় জামরাকে 'জামরায়ে আকাবা' বলা হয়।
২. কোরবানি : পাথর নিক্ষেপ করার পর এই দিন হাজিরা কোরবানি করবেন। ইফরাদ হজ সম্পাদনকারীর জন্য এরূপ কোরবানি করা সুন্নাত। আর কিরান ও তামাত্তু হজ সম্পাদনকারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে কোরবানি করতে হবে।
৩. মাথার চুল হলক বা কসর করা : কোরবানি করার পর হাজিরা ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চুল মুণ্ডন করবেন কিংবা ছোট করবেন। এটা করা ওয়াজিব। হেরেম শরিফের সীমানার ভেতর হলক বা কসর করতে হবে। হেরেম শরিফের বাইরে হলে সে জন্য জরিমানাস্বরূপ একটি কোরবানি করতে হবে। হলক বা কসর করার পর স্বামী-স্ত্রীর মিলন ছাড়া বাকি সব নিষিদ্ধ থাকা কাজ করা যাবে।
৪. তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করা : চুল হলক বা কসর করার পর হাজিরা বায়তুল্লাহ জিয়ারত করবেন। এই তাওয়াফ করা হজের ফরজের অন্তর্ভুক্ত। হাজরে আসওয়াদের স্থান থেকে তাওয়াফ শুরু করে মোট সাতবার তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফে জিয়ারতটি জিলহজ মাসের ১০, ১১ কিংবা ১২ তারিখ যেকোনো সময় করা যাবে। এই তাওয়াফ শেষ হলে স্বামী-স্ত্রীর মিলনও বৈধ হবে।
চতুর্থ দিন (১১ জিলহজ) : এই দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো সময় তিনটি জামরায় সাতটি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। কেউ যদি সূর্যাস্তের আগে পাথর নিক্ষেপ করতে না পারেন, তবে তিনি পরবর্তী সূর্যোদয়ের আগেই পাথর মারার কাজটি সম্পন্ন করবেন।
পঞ্চম দিন (১২ জিলহজ) : এই দিনও মিনার জামরায় আগের মতো পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। ১১ জিলহজ যদি কোনো হাজি পাথর নিক্ষেপ না করে থাকেন, তবে তিনি এই দিন তা কাজা আদায় করবেন এবং জরিমানাস্বরূপ একটি কোরবানি করবেন। যদি কোনো হাজি কোনো কারণে তাওয়াফে জিয়ারত ও আবশ্যকীয় কোরবানি না করে থাকেন, তবে তিনি তা এই দিনে সম্পন্ন করবেন। কারণ এই দিনই তাওয়াফ ও কোরবানির শেষ তারিখ।
ষষ্ঠ দিন (১৩ জিলহজ) : এই দিনও মিনায় আগের মতো জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে হবে এবং হাজিরা ইচ্ছা করলে মক্কায় এসে রাত যাপন করতে পারবেন। কিন্তু যদি কোনো হাজি এ রাতে মিনায় অবস্থান করেন, তবে তাকে পরদিনও আগের মতো জামরায় পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় আসতে হবে।
বিদায়ী তাওয়াফ : মিকাতের বাইরে থেকে আগত হাজিদের জন্য এটাই হলো হজের শেষ কাজ বা আমল। এই তাওয়াফের মাধ্যমে একজন হাজির হজবিষয়ক কার্যাবলির সমাপ্তি ঘটে। এই তাওয়াফকে তাওয়াফে সদরও বলা হয়।
লেখক : মিরাজ রহমান, প্রাবন্ধিক
Post a Comment