অধ্যাত্মবাদের সংজ্ঞা : অধ্যাত্মবাদ বা সুফিদর্শন ইসলামের এমন এক দর্শন, যেখানে আত্মার অবস্থা সম্পর্কিত আলোচনা মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাজকিয়ায়ে নফসের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মূলকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার ও চেনার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও কোরআন-হাদিসের জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টা হলো সুফিদর্শন বা অধ্যাত্মবাদ।
* মারুফ আল কারখি বলেন, 'অধ্যাত্মবাদ ঐশী সত্তার উপলব্ধি।' * জুনায়েদ বাগদাদি বলেন, 'জীবন, মৃত্যু ও অন্য সব ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভরতাই অধ্যাত্মবাদ।' * জাকারিয়া আনসারি বলেন, 'চিরন্তন ও নিখুঁত আনন্দলাভের জন্য ব্যক্তিসত্তাকে শুদ্ধীকরণ, নৈতিক চরিত্রের উন্নতিবিধান এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জীবনকে সঠিকভাবে গড়ে তোলাই অধ্যাত্মবাদ।' * ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর মতে, আল্লাহ ছাড়া অন্য মন্দ সব কিছু থেকে আত্মাকে কোরআন-হাদিসের আলোকে তাজকিয়ায়ে নফসের মাধ্যমে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই অধ্যাত্মবাদ।
অধ্যাত্মবাদের স্তরপরিক্রমা : ১. শরিয়ত, ২. তরিকত, ৩. মারিফত ও ৪. হাকিকত।
শরিয়ত : ইসলামী জীবনব্যবস্থার যাবতীয় বিধানকে শরিয়ত বলা হয়। সর্বপ্রথম শরিয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হয়। শরিয়তের যাবতীয় বিধানের মধ্য দিয়ে একজন সাধক তাঁর প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আত্মার অনুগত করেন। শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ ছাড়া কেউ সুফি হতে পারবেন না।
তরিকত : অধ্যাত্মবাদের পরিভাষায় তরিকত হচ্ছে, শরিয়তের যাবতীয় বিধান অনুশীলনের পর থেকে আধ্যাত্মিক গুরুর শরণাপন্ন হতে হবে। বিনা প্রশ্নে গুরুর আনুগত্য করতে হবে।
মারিফত : অধ্যাত্মবাদের পরিভাষায় মারিফত হচ্ছে এমন এক স্তর, যার মাধ্যমে বান্দা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে অবগতি অর্জন করতে পারে। এ স্তরে পেঁৗছতে পারলে তাঁর অন্তর আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন তিনি বস্তুর নিকট-তত্ত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেন।
হাকিকত : আন্তরিকভাবে খোদাপ্রেমের স্বাদ ও পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার চূড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফি ধ্যানের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব খোদার কাছে বিলীন করে দেন।
অধ্যাত্মবাদের ক্রমবিকাশ : ১. রাসুল (সা.)-এর যুগে অধ্যাত্মবাদ : রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় এর সূত্রপাত ঘটে। তিনি হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। একদল সাহাবি মসজিদে নববীর এক পাশে উপাসনা ও আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন।
২. খোলাফায়ে রাশেদার যুগে অধ্যাত্মবাদ : খলিফারা বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও পার্থিব সুখ-শান্তি কামনা করতেন না; তাঁরা আল্লাহর চিন্তায় ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাঁদের অনুসরণ করে একদল সাহাবি ও তাবেয়ি মোরাকাবা ও মোশাহাদায় সর্বদা লিপ্ত থাকতেন।
৩. উমাইয়া শাসনামলে অধ্যাত্মবাদ : উমাইয়া শাসনামলে অধ্যাত্মবাদের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এ সময় কয়েকজন সাধক আল্লাহর ধ্যানধারণাকেই জীবনে চরম ও পরম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এসব ধর্মতাপসদের মধ্যে ইমাম হাসান আল বসরি, আবু হাশিম, জাবির ইবনে হাইয়ান, রাবেয়া বসরি, ইব্রাহিম ইবনে আদহাম, মারুফ আল-কারখি অন্যতম।
৪. আব্বাসীয় শাসনামলে অধ্যাত্মবাদ : আব্বাসীয় শাসনামলে সুফি মতবাদ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে থাকে। এ যুগকে ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে সুফি মতবাদের ওপর বিদেশি প্রভাব বিস্তার হতে থাকে। একপর্যায়ে সুফিদের মধ্যে দুটি দলের সৃষ্টি হয়।
ক. ইনকিশাফি দল : এ দলের পুরোধা ছিলেন হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.), জুনায়েদ বাগদাদি (রহ.) প্রমুখ।
খ. ইসতিদলালি দল : এ দলের সুফিদের মধ্যে স্পেনের মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি ও রোমের মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) অন্যতম।
৫. এ স্তরে ইমাম গাজ্জালির খেদমত অপরিসীম। তিনি অধ্যাত্মবাদের ওপর অনেক বই রচনা করেন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি অধ্যাত্মবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অধ্যাত্মবাদের প্রথম উৎপত্তি আরবে, পরে এটা ইরানে প্রসারিত হয় এবং ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করে। ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, সাদি, জামি প্রমুখ সুফি ইরানেই জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর এই অধ্যাত্মবাদ ভারতবর্ষেও অনুপ্রবেশ করে। বর্তমানে প্রায় সব দেশে তরিকতের ইমামরা অধ্যাত্মবাদ প্রচার করে চলেছেন। উপমহাদেশে এর খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি আরব দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
অধ্যাত্মবাদের মূলনীতি : অধ্যাত্মবাদ একরকম রহস্যময় হৃদয়ভিত্তিক ও আত্মাপলব্ধিমূলক মতবাদ। একে রুহানি প্রশিক্ষণও বলা হয়। ব্যক্তির আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরম সত্তার সন্ধানই এর লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে পেঁৗছার জন্য সুফিরা কতকগুলো মূলনীতি তৈরি করেছেন_
১. তাওবা : অন্যায় ও পাপের ওপর আন্তরিক অনুশোচনা, অন্যায়ের স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যতে এ কাজ না করার দৃপ্ত শপথ। তাওবা হচ্ছে অধ্যাত্মবাদের প্রথম মূলনীতি।
২. তাওয়াক্কুল : সর্বাবস্থায় দয়াময় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করাই তাওয়াক্কুল।
৩. পরিবর্জন : এ প্রসঙ্গে নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেন, 'স্বল্প আহার, স্বল্প কথন, স্বল্প মেলামেশা, স্বল্প নিদ্রার মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের পূর্ণতা।'
৪. সবর বা ধৈর্য : যেকোনো অবস্থায় অস্থির না হয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে মেনে নেওয়াই সবরের একমাত্র দাবি।
৫. আত্মসমর্পণ : গুরুর কাছে নিজ আত্মাকে সোপর্দ করে দিতে হবে।
৬. ইখলাস : নিছক আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সব কাজ করতে হবে।
৭. আল্লাহর প্রেম : অন্তরে পার্থিব জগতের কোনো কিছুর প্রেম ও মোহ থাকতে পারে না। সর্বক্ষণ আল্লাহকে পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকতে হবে।
৮. আল্লাহর জিকির : আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন ও অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য চাই সর্বদা আল্লাহর জিকির।
৯. শোকর : আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান ও আনুগত্য করাকে শোকর বলা হয়।
১০. কাশফ : সুফিরা যখন আধ্যাত্মিক সাধনার চরম পর্যায়ে উপনীত হন, তখন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। এবং তাঁর সামনে গোপনীয় সব রহস্যদ্বার খুলে যায়। একপর্যায়ে তিনি আল্লাহর অসীমতার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন।
লেখক : এম মিজানুর রমাহন সোহেল, প্রাবন্ধিক
Post a Comment