السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

পর্দা বিষয়ে সূরা নূরে কিছু বর্ণনা

| comments

আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে 
৩১
নারীদের জন্যও পুরুষদের মতো দৃষ্টি সংযমের একই বিধান রয়েছে। অর্থাৎ তাদের ইচ্ছা করে ভিন্ পুরুষদের দেখা উচিত নয়। ভিন্ পুরষদের প্রতি দৃষ্টি পড়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া উচিত এবং অন্যদের সতর দেখা থেকে দূরে থাকা উচিত। কিন্তু পুরুষদের পক্ষ...ে মেয়েদেরকে দেখার তুলনায় মেয়েদের পক্ষে পুরুষদেরকে দেখার ব্যাপারে কিছু ভিন্ন বিধান রয়েছে। একদিকে হাদীসে আমরা এ ঘটনা পাচ্ছি যে, হযরত উম্মে সালামাহ ও হযরত উম্মে মাইমূনাহ নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসেছিলেন এমন সময় হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম এসে গেলেন। নবী ﷺ উভয় স্ত্রীকে বললেন, “তার থেকে পর্দা করো।” স্ত্রীরা বললেনঃ

“হে আল্লাহর রসূল! তিনি কি অন্ধ নন? তিনি আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না এবং চিনতেও পাচ্ছেন না।” বললেনঃ “তোমরা দুজনও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না?” হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, এটা যখন পর্দার হুকুম নাযিল হয়নি সে সময়কার ঘটনা।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এবং মুআত্তার একটি রেওয়ায়াত এর সমর্থন করে, যাতে বলা হয়েছেঃ হযরত আয়েশা কাছে একজন অন্ধ এলেন এবং তিনি তার থেকে পর্দা করলেন। বলা হলো, আপনি এর থেকে পর্দা করছেন কেন? এ¬-তো আপনাকে দেখতে পারে না। উম্মুল মু’মিনীন (রা.) এর জবাবে বললেনঃ “কিন্তু আমি তো তাকে দেখছি।” অন্যদিকে আমরা হযরত আয়েশার একটি হাদীস পাই, তাতে দেখা যায়, ৭ হিজরী সনে হাবশীদের প্রতিনিধি দল মদীনায় এলো এবং তারা মসজিদে নববীর চত্বরে একটি খেলার আয়োজন করলো। নবী ﷺ নিজে হযরত আয়েশাকে এ খেলা দেখালেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ) তৃতীয় দিকে আমরা দেখি, ফাতেমা বিনতে কায়েসকে যখন তাঁর স্বামী তিন তালাক দিলেন তখন প্রশ্ন দেখা দিল তিনি কোথায় ইদ্দত পালন করবেন। প্রথমে নবী করীম ﷺ বললেন, উম্মে শরীক আনসারীর কাছে থাকো। তারপর বললেন, তার কাছে আমার সাহাবীগণ অনেক বেশী যাওয়া আশা করে (কারণ তিনি ছিলেন একজন বিপুল ধনশালী ও দানশীলা মহিলা। বহু লোক তাঁর বাড়িতে মেহমান থাকতেন এবং তিনি তাদের মেহমানদারী করতেন।) কাজেই তুমি ইবনে উম্মে মাকতুমের ওখানে থাকো। সে অন্ধ। তুমি তার ওখানে নিঃসংকোচে থাকতে পারবে।” (মুসলিম ও আবু দাউদ)

এসব বর্ণনা একত্র করলে জানা যায়, পুরুষদেরকে দেখার ব্যাপারে মহিলাদের ওপর তেমন বেশী কড়াকড়ি নেই যেমন মহিলাদেরকে দেখার ব্যাপারে পুরুষের ওপর আরোপিত হয়েছে। এক মজলিসে মুখোমুখি বসে দেখা নিষিদ্ধ। পথ চলার সময় অথবা দূর থেকে কোন কোন জায়েয খেলা দেখতে গিয়ে পুরুষদের ওপর দৃষ্টি পড়া নিষিদ্ধ নয়। আর কোন যথার্থ প্রয়োজন দেখা দিলে একই বাড়িতে থাকা অবস্থায়ও দেখলে কোন ক্ষতি নেই। ইমাম গায্যালী ও ইবনে হাজার আসকালানীও হাদীসগুলো থেকে প্রায় এ একই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। শাওকানী নাইলুল আওতারে ইবনে হাজারের এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, “এ থেকেও বৈধতার প্রতি সমর্থন পাওয়া যায় যে, মেয়েদের বাইরে বের হবার ব্যাপারে সবসময় বৈধতাকেই কার্যকর করা হয়েছে। মসজিদে, বাজারে এবং সফরে মেয়েরা তো মুখে নেকাব দিয়ে যেতো, যাতে পুরুষরা তাদেরকে না দেখে। কিন্তু পুরুষদেরকে কখনো এ হুকুম দেয়া হয় না যে, তোমরাও নেকার পরো, যাতে মেয়েরা তোমাদেরকে না দেখে। এ থেকে জানা যায়, উভয়ের ব্যাপারে হুকুমের মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে।” (৬ষ্ঠ খণ্ড, ১০১ পৃষ্ঠা) তবুও মেয়েরা নিশ্চিন্ত পুরুষদেরকে দেখবে এবং তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকবে, এটা কোনক্রমেই জায়েয নয়।

এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে ৩২
অর্থাৎ অবৈধ যৌন উপভোগ থেকে দূরে থাকে এবং নিজের সতর অন্যের সামনে উন্মুক্ত করাও পরিহার করে। এ ব্যাপারে মহিলাদের ও পুরুষদের জন্য একই বিধান, কিন্তু নারীদের সতরের সীমানা পুরুষদের থেকে আলাদা। তাছাড়া মেয়েদের সতর মেয়েদের ও পুরুষদের জন্য আবার ভি...ন্ন ভিন্ন।

পুরুষদের জন্য মেয়েদের সতর হাত ও মুখ ছাড়া তার সারা শরীর। স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষ এমন কি বাপ ও ভাইয়ের সামনেও তা খোলা উচিত নয়। মেয়েদের এমন পাতলা বা চোস্ত পোশাক পরা উচিত নয় যার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় বা শরীরের গঠন কাঠামো ভেতর থেকে ফুটে উঠতে থাকে। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, তাঁর বোন হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে আসেন। তখন তিনি পাত্লা কাপড় পড়ে ছিলেন। রসূলুল্লাহু (স) সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ

“হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার মুখ ও হাত ছাড়া শরীরের কোন অংশ দেখা যাওয়া জায়েয নয়।” (আবুদ দাউদ)

এ ধরনের আর একটি ঘটনা ইবনে জারীর হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ তাঁর কাছে তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনুত তোফায়েলের মেয়ে আসেন। রসূলুল্লাহ ﷺ গৃহে প্রবেশ করে তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেন। হযরত আয়েশা বলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ হচ্ছে আমার ভাইয়ের মেয়ে। তিনি বলেনঃ

“মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার জন্য নিজের মুখ ও হাত ছাড়া আর কিছু বের করে রাখা হালাল নয়, আর নিজের কব্জির ওপর হাত রেখে হাতের সীমানা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর মুঠি ও হাতের তালুর মধ্যে মাত্র একমুঠি পরিমাণ জায়গা খালি থাকে।”

এ ব্যাপারে শুধুমাত্র এতটুকু সুযোগ আছে যে, ঘরে কাজকর্ম করার জন্য মেয়েদের শরীরের যতটুকু অংশ খোলার প্রয়োজন দেখা দেয় নিজেদের মুহাররাম আত্মীয়দের (যেমন বাপ-ভাই ইত্যাদি) সামনে মেয়েরা শরীরে কেবলমাত্র ততটুকু অংশই খুলতে পারে। যেমন আটা মাখাবার সময় হাতের আস্তিন গুটনো অথবা ঘরের মেঝে ধুয়ে ফেলার সময় পায়ের কাপড় কিছু ওপরের দিকে তুলে নেয়া।

আর মহিলদের জন্য মহিলাদের সতরের সীমারেখা হচ্ছে পুরুষদের জন্য পুরুষদের সতরের সীমা রেখার মতই। অর্থাৎ নাভী ও হাঁটুর মাঝখানের অংশ। এর অর্থ এ নয় যে, মহিলাদের সামনে মহিলারা অর্ধ উলংগ থাকবে। বরং এর অর্থ শুধুমাত্র এই যে, নাভী ও হাঁটুর মাঝখানের অংশটুকু ঢাকা হচ্ছে ফরয এবং অন্য অংশগুলো ঢাকা ফরয নয়।

আর ৩৩
এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর শরীয়াত নারীদের কাছে শুধুমাত্র এতটুকুই দাবী করে না যতটুকু পুরুষদের কাছে করে। অর্থাৎ দৃষ্টি সংযত করা এবং লজ্জাস্থানের হেফাজাত করা। বরং তাদের কাছ থেকে আরো বেশী কিছু দাবী করে। এ দাবী পুরুষদের কাছে করেনি। পুরুষ ও নারী যে এ ব্যাপারে সমান নয় তা এ থেকে পরিষ্কার প্রকাশ হয়।


তাদের সাজসজ্জা না দেখায়,৩৪

আমি শব্দের অনুবাদ করেছি “সাজসজ্জা”। এর দ্বিতীয় আর একটি অনুবাদ হতে পারে প্রসাধন। তিনটি জিনিসের ওপর এটি প্রযুক্ত হয়। সুন্দর কাপড়, অলংকার এবং মাথা, মুখ, হাত-পা ইত্যাদির বিভিন্ন সাজসজ্জা, যেগুলো সাধারণত মেয়েরা করে থাকে। আজকের দুনিয়ায় এজন্য “মেকআপ” (Makeup) শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ সাজসজ্জা কাকে দেখানো যাবে না এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা সামনের দিকে আসছে।


যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। ৩৫
তাফসীরগুলোর বিভিন্ন বর্ণনা এ আয়াতটির অর্থ যথেষ্ট অস্পষ্ট করে তুলেছে। অন্যথায় কথাটি মোটেই অস্পষ্ট নয়, একেবারেই পরিষ্কার। প্রথম বাক্যাংশে বলা হয়েছে অর্থাৎ “তারা যেন নিজেদের সাজসজ্জা ও প্রসাধন প্রকাশ না করে।” আর দ্বিতীয় বাক্যাংশে শব...্দটি বলে এ নিষেধাজ্ঞায় যেসব জিনিসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে যাকে আলাদা তথা নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে তা হচ্ছে, “যা কিছু এ সাজসজ্জা থেকে আপনা আপনি প্রকাশ হয় বা প্রকাশ হয়ে যায়।” এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, মহিলাদের নিজেদের স্বেচ্ছায় এগুলো প্রকাশ ও এসবের প্রদর্শনী না করা উচিত। তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় (যেমন চাদর বাতাসে উড়ে যাওয়া এবং কোন আভরণ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া) অথবা যা নিজে নিজে প্রকাশিত (যেমন ওপরে যে চারদটি জড়ানো থাকে, কোনক্রমেই তাকে লুকানো তো সম্ভব নয় আর নারীদের শরীরের সাথে লেপটে থাকার কারণে মোটামুটিভাবে তার মধ্যেও স্বতঃষ্ফুর্তভাবে একটি আকর্ষন সৃষ্টি হয়ে যায়) সেজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন জবাবদিহি নেই। এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন ও ইবরাহীম নাখ্ঈ। পক্ষান্তরের কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেনঃ (মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ করে দেয়) এবং তারপর তারা এর মধ্যে শামিল করে দিয়েছেন মুখ ও হাতকে তাদের সমস্ত সাজসজ্জাসহ। অর্থাৎ তাদের মতে মহিলারা তাদের গালে রুজ পাউডার, ঠোঁটে লিপষ্টিক ও চোখে সুরমা লাগিয়ে এবং হাতে আংটি, চুড়ি ও কংকন ইত্যাদি পরে তা উন্মুক্ত রেখে লোকদের সামনে চলাফেরা করবে। ইবনে আব্বাস (রা.) ও তাঁর শিষ্যগণ এ অর্থ বর্ণনা করেছেন। হানাফী ফকীহদের একটি বিরাট অংশও অর্থ গ্রহণ করেছেন। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৮৮-৩৮৯ পৃষ্ঠা) কিন্তু আরবী ভাষার কোন্ নিয়মে কে এর অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে তা আমি বুঝতে অক্ষম। “প্রকাশ হওয়া” ও “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে এবং আমরা দেখি কুরআন স্পষ্টভাবে “প্রকাশ করার” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়ার” ব্যাপারে অবকাশ দিচ্ছে। এ অবকাশকে “প্রকাশ করা” পর্যন্ত বিস্তৃত করা কুরআনেরও বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেরও বিরোধ যেগুলো থেকে প্রমাণ হয় যে, নববী যুগে হিজাবের হুকুম এসে যাবার পর মহিলারা মুখে খুলে চলতো না, হিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দাও শামিল ছিল এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য সব অবস্থায় নেকাবকে মহিলাদের পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিল। তারপর এর চাইতেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এ অবকাশের পক্ষে যুক্তি হিসেবে একথা পেশ করা হয় যে, মুখ ও হাত মহিলাদের সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ সতর ও হিজাবের মধ্যে যমীন আসমান ফারাক। সতর মুহাররাম পুরুষদের সামনে খোলাও জায়েয নয়। আর হিজাব তো সতরের অতিরিক্ত এটি জিনিস, যাকে নারীদের ও গায়ের মুহাররাম পুরুষদের মাঝখানে আটকে দেয়া হয়েছে এবং এখানে সতরের নয় বরং হিজাবের বিধান আলোচ্য বিষয়।

আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। ৩৬
জাহেলী যুগে মহিলারা মাথায় এক ধরনের আঁটসাঁট বাঁধন দিতো। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সাথে এর গিরো বাঁধা থাকতো। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের ওপরের দিকে অংশটি পরিষ্কার দেখা যেতো। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। প...েছনের দিকে দুটো তিনটে খোঁপা দেখা যেতো। (তাফসীরে কাশ্শাফ, ২য় খণ্ড, ৯০ পৃষ্ঠা, ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড ২৮৩-২৮৪ পৃষ্ঠা) এ আয়াত নাযিল হবার পর মুসলমান মহিলাদের মধ্যে ওড়নার প্রচলন করা হয়। আজকালকার মেয়েদের মতো তাকে ভাঁজ করে পেঁচিয়ে গলার মালা বানানো এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এটি শরীরে জড়িয়ে মাথা, কোমর, বুক ইত্যাদি সব ভালোভাবে ঢেকে নেয়া ছিল এর উদ্দেশ্য। মু’মিন মহিলারা কুরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে একে কার্যকর করে হযরত আয়েশা (রা.) তার প্রশংসা করে বলেনঃ সূরা নূর নাযিল হলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে তা শুনে লোকেরা ঘরে ফিরে আসে এবং নিজেদের স্ত্রী, মেয়ে ও বোনদের আয়াতগুলো শোনায়। রদের মেয়েদের মধ্যে এমন একজনও ছিল না বাক্যাংশ শোনার পর নিজের জায়গায় চুপটি করে বসে ছিল। প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেললো। পরদিন ফজরের নামাযের সময় যতগুলো মহিলা মসজিদে নববীতে হাজির হয়েছিল তাদের সবাই দোপাট্টা ও ওড়ানা পরা ছিল। এ সম্পর্কিত অন্য একটি হাদীসে হযরত আয়েশা (রা.) আরো বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেনঃ মহিলারা পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে নিজেদের মোটা কাপড় বাছাই করে তা দিয়ে ওড়না তৈরী করলেন। (ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ২৮৪ পৃঃ এবং আবু দাউদ, পোশাক অধ্যায়)

ওড়না পাতলা কাপড়ের না হওয়া উচিত। এ বিধানগুলোর মেজাজ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করলে এ বিষয়টি নিজে নিজেই উপলব্ধি করা যায়। কাজেই আনসারদের মহিলারা হুকুম শুনেই বুঝতে পেরেছিল কোন্ ধরনের কাপড় দিয়ে ওড়না তৈরী করলে এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। কিন্তু শরীয়াত প্রবর্তক ﷺ একথাটিকে শুধুমাত্র লোকদের বোধ ও উপলব্ধির ওপর ছেড়ে দেননি বরং তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। দেহ্ইয়াহ কাল্বী বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মিসরের তৈরী সূক্ষ্ম মল্মল্ (কাবাতী) এলো। তিনি তা থেকে এক টুকরা আমাকে দিলেন এবং বললেন, এখান থেকে কেটে এক খণ্ড দিয়ে তোমার নিজের জামা তৈরী করে নাও এবং এক অংশ দিয়ে তোমার স্ত্রীর দোপাট্টা বানিয়ে দাও, কিন্তু তাকে বলে দেবে এর নিচে যেন আর একটি কাপড় লাগিয়ে নেয়, যাতে শরীরের গঠন ভেতর থেকে দেখা না যায়।” (আবু দাউদ, পোশাক অধ্যায়)।

তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া ৩৭
অর্থাৎ যাদের মধ্য একটি মহিলা তার পূর্ণ সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা সহকারে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে এসব লোক হচ্ছে তারাই। এ জনগোষ্ঠীর বাইরে আত্মীয় বা অনাত্মীয় যে-ই থাক না কেন কোন নারীর তার সামনে সাজগোজ করে আসা বৈধ নয়। বাক্যে যে হুকুম দেয়া হয়েছিল ত...ার অর্থ এখানে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে এভাবে যে, এ সীমিত গোষ্ঠীর বাইরে যারাই আছেন তাদের সামনে নারীর সাজসজ্জা ইচ্ছাকৃত বা বেপরোয়াভাবে নিজেই প্রকাশ করা উচিত নয়, তবে তার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অথবা তার ইচ্ছা ছাড়াই যা প্রকাশ হয়ে যায় অথবা যা গোপন করা সম্ভব না হয় তা আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য।

স্বামী, বাপ, স্বামীর বাপ,৩৮
মূলে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ শুধু বাপ নয় বরং দাদা ও দাদার বাপ এবং নানা ও নানার বাপও এর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই একটি মহিলা যেভাবে তার বাপ ও শ্বশুরের সামনে আসতে পারে ঠিক তেমনিভাবে আসতে পারে তার বাপের ও নানার বাড়ির এসব মুরব্বীদের সামনে...ও।

নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে,৩৯
ছেলের অন্তর্ভুক্ত হবে নাতি, নাতির ছেলে, দৌহিত্র ও দৌহিত্রের ছেলে সবাই। আর এ ব্যাপারে নিজের ও সতীনের মধ্যে কোন ফারাক নেই। নিজের সতীন পুত্রদের সন্তানদের সামনে নারীরা ঠিক তেমনি স্বাধীনভাবে সাজসজ্জার প্রকাশ করতে পারে যেমন নিজের সন্তানদের ও সন্তানদের সন্তানদের সামনে করতে পারে।

ভাই, ৪০
ভাইয়ের মধ্যে সহোদর ভাই, বৈমাত্রেয় এবং বৈপিত্রেয় ভাই সবাই শামিল।

ভাইয়ের ছেলে,৪১
ভাই-বোনদের ছেলে বলতে তিন ধরনের ভাই-বোনদের সন্তান বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তাদের নাতি, নাতির ছেলে এবং দৌহিত্র ও দোহিত্রের ছেলে সবাই এর অন্তভুক্ত।

বোনের ছেলে,৪২
এখানে যেহেতু আত্মীয়দের গোষ্ঠী খতম হয়ে যাচ্ছে তাই সামনের দিকে অনাত্মীয় লোকদের কথা বলা হচ্ছে। এজন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আগে তিনটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। কারণ এ বিষয়গুলো না বুঝলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

প্রথম বিষয়টি হচ্ছে..., কেউ কেউ সাজসজ্জা প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেবলমাত্র এমন সব আত্মীয় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ মনে করেন যাদের নাম এখানে উচ্চারণ করা হয়েছে। বাকি সবাইকের এমনকি আপন চাচা ও আপন মামাকে যেসব আত্মীয়দের থেকে পর্দা করতে হবে তাদের মধ্য গণ্য করেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এদের নাম কুরআনে বলা হয়নি। কিন্তু একথা সঠিক নয়। আপন চাচা ও মামা তো দূরের কথা রসূলুল্লাহ ﷺ তো দুধ চাচা ও দুধ মামা থেকেও পর্দা করতে হযরত আয়েশাকে অনুমতি দেননি। সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ আবুল কু’আইসের ভাই আফ্লাহ তাঁর কাছে এলেন এবং ভেতর প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। যেহেতু তখন পর্দার হুকুম নাযিল হয়ে গিয়েছিল, তাই হযরত আয়েশা অনুমতি দিলেন না। তিনি বলেন পাঠালেন, তুমি তো আমার ভাইঝি, কারণ তুমি আমার ভাই আবুল কু’আইসের স্ত্রীর দুধ পান করেছো। কিন্তু এ সম্পর্কটা কি এমন পর্যায়ের যেখানে পর্দা উঠিয়ে দেয়া জায়েয এ ব্যাপারে হযরত আয়েশা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ইত্যবসরে নবী সাল্লালাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম এসে গেলেন। তিনি বললেন, সে তোমার কাছে আসতে পারে। এ থেকে জানা যায়, নবী ﷺ নিজেই এ আয়াতকে এ অর্থে নেননি যে, এর মধ্যে যেসব আত্মীয়ের কথা বলা হয়েছে কেবল তাদের থেকে পর্দা করা হবে না এবং বাকি সবার থেকে পর্দা করা হবে। বরং তিনি এ থেকে নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, যেসব আত্মীয়ের সাথে একটি মেয়ের বিয়ে হারাম তারা সবাই এ আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন চাচা, মামা, জামাতা ও দুধ সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন। তাবে’ঈদের মধ্যে হযরত হাসান বসরীও এ মত প্রকাশ করেছেন এবং আল্লাম আবু বকর জাস্সাস আহকামুল কুরআনে এর প্রতিই সমর্থন জানিয়েছেন। (৩য় খণ্ড, ৩৯০ পৃষ্ঠা)

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, যেসব আত্মীয়ের সাথে চিরন্তন হারামের সম্পর্ক নয় (অর্থাৎ যাদের সাথে একজন কুমারী বা বিধবার বিয়ে বৈধ) তারা মুহাররাম আত্মীয়দের অন্তর্ভুক্ত নয়। মেয়েরা নিসংকোছে সাজসজ্জা করে তাদের সামনে আসবে না। আবার একেবারে অনাত্মীয় অপরিচিতদে...র মতো তাদের থেকে তেমনি পূর্ণ পর্দাও করবে না যেমন ভিন পুরুষদের থেকে করে। এ দুই প্রান্তিকতার মাঝামাঝি কি দৃষ্টিভংগী হওয়া উচিত তা শরীয়াতে নির্ধারিত নেই। কারণ এটা নির্ধারিত হতে পারে না। এর সীমানা বিভিন্ন আত্মীয়ের ব্যাপারে তাদের আত্মীয়তা, বয়স, পারিবারিক সম্পর্ক ও সম্বন্ধ এবং উভয়পক্ষের অবস্থার (যেমন এক গৃহে বা আলাদা আলাদা বাস করা) প্রেক্ষিতে অবশ্যি বিভিন্ন হবে এবং হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের নিয়ম ও কর্মপদ্ধতি যা কিছু ছিল তা থেকে আমরা এ দিকনির্দেশনাই পাই। হযরত আসরা বিনতে আবু বকর ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্যালিকা। বহু হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি রসূলের ﷺ সামনে আসতেন এবং শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর ও নবী সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে কমপক্ষে চেহারা ও হাতের ক্ষেত্রে কোন পর্দা ছিল না। বিদায় হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় নবীর ﷺ ইন্তিকালের মাত্র কয়েক মাস আগে এবং সে সময় এ অবস্থাই বিরাজিত ছিল (দেখুন আবু দাউদ, হজ্জ অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ মুহাররাম তার গোলামকে আদব শিক্ষা দেবে)। অনুরূপভাবে হযরত উম্মেহানী ছিলে আবু তালেবের মেয়ে ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতে বোন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি নবী করীমের ﷺ সামনে আসতেন এবং কমপক্ষে তাঁর সামনে কখনো নিজের মুখ ও চেহারার পর্দা করেননি। মক্কা বিজয়ের সময়ের একটি ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। এ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। (দেখুন আবু দাউদ, কিতাবুস সওম, বাবুন ফীন নীয়্যাত ফিস সওমে ওয়ার রূখসাতে ফকীহ।) অন্যদিক আমরা দেখি, হযরত আব্বাস তাঁর ছেলে ফযলকে এবং বারী’আহ ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন চাচাত ভাই) তাঁর ছেলে আবদুল মুত্তালিবকে নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ বলে পাঠালেন যে, এখন তোমরা যুবক হয়ে গেছো, তোমরা রোজাগারের ব্যবস্থা করতে না পারলে তোমাদের বিয়ে হতে পারে না, কাজেই তোমরা রসূলের ﷺ কাছে গিয়ে কোন চাকরির দরখাস্ত করো। তারা দু’জন হযরত যয়নবের গৃহে গিয়ে রসূলুল্লাহর খিদমতে হাযির হলেন। হযরত যয়নব ছিলেন ফযলের আপন ফুপাত বোন আর আবদুল মুত্তালিব ইবনে রাবী’আর বাপের সাথেও তাঁর ফযলের সাথে যেমন তেমনি আত্মীয় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি তাদের দু’জনের সামনে হাযির হলেন না এবং রসূলের ﷺ উপস্থিতিতে পর্দার পেছন থেকে তাদের সাথে কথা বলতে থাকলেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল খারাজ) এ দু’ধরনের ঘটনাবলী মিলিয়ে দেখলে ওপরে আমি যা বর্ণনা করে এসেছি বিষয়টির সে চেহারাই বোধগম্য হবে।

তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, যেখানে আত্মীয়তা সন্দেহপূর্ণ হয়ে যায় সেখানে মুহাররাম আত্মীয়দের থেকেও সতর্কতা হিসেবে পর্দা করা উচিত। বুখারী, মুসলিম ও আবুদ দাউদে উদ্ধৃত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত সওদার (রা.) এক ভাই ছিল বাঁদিপুত্র (অর্থাৎ তাঁর পিতার ক্রীতদা...সীর গর্ভজাত ছিল)। তাঁর সম্পর্ক হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসকে (রা.) তাঁর ভাই উত্বা এ মর্মে অসীয়াত করেন যে, এ ছেলেকে নিজের ভাতিজা মনে করে তার অভিভাবকত্ব করবে কারণ সে আসলে আমার ওরসজাত। এ মামলাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলো। তিনি হযরত সাদের দাবী এই বলে নাকচ করে দিলেন যে, “যার বিছানায় সন্তানের জন্ম হয়েছে সে-ই সন্তানের পিতা। আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর।” কিন্তু সাথে সাথেই তিনি হযরত সওদাকে বলে দিলেন, এ ছেলেটি থেকে পর্দা করবে কারণ সে যে সত্যিই তার ভাই এ ব্যাপারে নিসন্দেহ হওয়া যায়নি।

নিজের মেলামেশার মেয়েদের, ৪৩
মূলে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে, “তাদের মহিলারা” এখানে কোন্ মহিলাদের কথা বলা হয়েছে সে বির্তকে পরে আসা যাবে। এখন সবার আগে যে কথাটি উল্লেখযোগ্য এবং যেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত সেটি হচ্ছে, এখানে নিছক “মহিলারা” বলা হয়নি, যার ফল...ে মুসলমান মহিলার জন্য সমস্ত মহিলাদের এবং সব ধরনের মেয়েদের সামনে বেপর্দা হওয়া ও সাজসজ্জা প্রকাশ করা জায়েয হয়ে যেতো। বরং বলে মহিলাদের সাথে তার স্বাধীনতাকে সর্বাবস্থায় একটি বিশেষ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। সে গণ্ডীর যে কোন পর্যায়েরই হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, এটা কোন্ গণ্ডী এবং সে মহিলারাই বা কারা যাদের ওপর শব্দ প্রযুক্ত হয়? এর জবাব হচ্ছে, এ ব্যাপারে ফকীহ ও মুফাসসিরগণের উক্তি বিভিন্নঃ

একটি দল বলেন, এখানে কেবলমাত্র মুসলমান মেয়েদের কথা বলা হয়েছে। যিম্মী বা অন্য যে কোন ধরনের অমুসলিম মেয়েরাই হোক না কোন মুসলমান মেয়েদেরকে তাদের থেকে পুরুষদের থেকে যেমন করা হয় তেমনি পর্দা করা উচিত। ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও জুরাইজ এ মত পোষণ করেন। এরাঁ নিজেদের সমর্থনে এ ঘটনাটিও পেশ করে থাকেন যে, হযরত উমর (রা.) হযরত আবু উবাইদাহকে লেখেন, “আমি শুনেছি কিছু কিছু মুসলিম নারী অমুসলিম নারীদের সাথে হাম্মামে যাওয়া শুরু করেছেন। অথচ যে নারী আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে তার জন্য তার শরীরের ওপর তার মিল্লাতের অন্তর্ভুক্তদের ছাড়া অন্য কারোর দৃষ্টি পড়া হালাল নয়।” এ পত্র যখন হযরত আবু উবাইদাহ পান তখন তিনি হঠাৎ ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং বলতে থাকেন, “হে আল্লাহ! যে সব মুসলমান মহিলা নিছক ফর্সা হবার জন্য এসব হাম্মামে যায় তাদের মুখ যেন আখেরাতে কালো হয়ে যায়।” (ইবনে জারীর, বায়হাকী ও ইবনে কাসীর)

দ্বিতীয় দলটি বলেন, এখানে সব নারীদের কথা বলা হয়েছে। ইমাম রাযীর দৃষ্টিতে এ মতটিই সঠিক। কিন্তু একথা বোধগম্য নয় যে, যদি সত্যিই আল্লাহর উদ্দেশ্য এটিই হয়ে থাকে তাহলে আবার বলার অর্থ কি? এ অবস্থায় তো শুধু বলা উচিত ছিল।

তৃতীয় মতটিই যুক্তিসঙ্গত এবং কুরআনের শব্দের নিকটতরও। সেটি হচ্ছে, যেসব নারীদের সাথে তারা মেলামেশা করে, যাদের সাথে তাদের জানাশোনা আছে, যাদের সাথে তারা সম্পর্কে রাখে এবং যারা তাদের কাজে-কর্মে অংশ নেয় তাদের কথা এখানে বলা হয়েছে। তারা মুসলিমও হতে পারে আবার অমুসলিমও। অপরিচিত মহিলাদের যাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণের অবস্থা জানা নেই অথবা যাদের বাইরের অবস্থা সন্দেহজনক এবং যারা নির্ভরযোগ্য নয়, তাদেরকে এ গণ্ডীর বাইরে রাখাই এর উদ্দেশ্য। কিছু সহীহ হাদীস থেকে এ মতের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীসগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীদের কাছে যিম্মি মহিলাদের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে যে আসল জিনিসটির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হবে সেটি ধর্মীয় বিভিন্নতা নয় বরং নৈতিক অবস্থা। অমুসলিম হলেও পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য পরিবারের ভদ্র, লজ্জাশীলা ও সদাচারী মহিলাদের সাথে মুসলিম মহিলারা পুরোপুরি নিঃসংকোচে মেলামেশা করতে পারে। কিন্তু মুসলমান মেয়েরাও যদি বেহায়া, বেপর্দা ও অসদাচারী হয় তাহলে প্রত্যেক শরীফ ও ভদ্র পরিবারের মহিলার তাদের থেকে পর্দা করা উচিত। কারণ নৈতিকতার জন্য তাদের সাহচার্য ভিন্ পুরুষদের সাহচর্যের তুলনায় কম ক্ষতিকর নয়। আর অপরিচিত মহিলারা যাদের অবস্থা জানা নেই, তাদের সাথে মেলামেশা করার সীমানা আমাদের মতে গায়ের মুহাররাম আত্মীয়দের সামনে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সর্বাধিক সীমানার সমপরিমাণ হতে পারে। অর্থাৎ তাদের সামনে মহিলারা কেবলমাত্র মুখ ও হাত খুলতে পারে, বাকি সারা শরীর ও অংগসজ্জা ঢেকে রাখতে হবে।

নিজের মালিকানাধীনদের, ৪৪
এ নির্দেশটির অর্থ বুঝার ব্যাপারেও ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। একটি দল এর অর্থ করেছেন এমন সব বাঁদী যারা কোন মহিলার মালিকানাধীন আছে। তাদের মতে, আল্লাহর উক্তির অর্থ হচ্ছে, বাঁদী মুশরিক বা আহলি কিতাব যে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন মুসলিম ...মহিলা মালিক তার সামনে তো সাজসজ্জা প্রকাশ করতে পারে কিন্তু মহিলার নিজেরই মালিকানাধীন গোলামের থেকেও পর্দা করার ব্যাপারটি অপরিচিত স্বাধীন পুরুষের থেকে পর্দার সমপর্যায়ের। এটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), মুজাহিদ, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন, সা’ঈদ ইবনে মুসাইইব, তাউস ও ইমাম আবু হানীফার মত। ইমাম শাফেঈ’র একটি উক্তিও এর সমর্থনে পাওয়া যায়। এ মনীষীদের যুক্তি হচ্ছে, গোলামের জন্য তার মহিলা মালিক মুহাররাম নয়। যদি সে স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে তার আগের মহিলা মালিককে বিয়েও করতে পারে। কাজেই নিছক গোলামী এমন কোন কারণ হতে পারে না যার ফলে মহিলারা তাদের সামনে এমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে যার অনুমতি মুহাররাম পুরুষদের সামনে চলাফেরা করার জন্য দেয়া হয়েছে। এখন বাকী থাকে এ প্রশ্নটি যে, শব্দাবলী ব্যাপক অর্থবোধক, গোলাম ও বাঁদী উভয়ের জন্য ব্যবহার হয়, তাহলে আবার বিশেষভাবে বাঁদীদের জন্য একে ব্যবহার করার যুক্তি কি? এর জবাব তারা এভাবে দেন যে, এ শব্দাবলী যদিও ব্যাপক অর্থবোধক তবুও পরিবেশ ও পরিস্থিতি এগুলোর অর্থকে মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ করছে। প্রথমে বলা হয় তারপর বলা হয় প্রথমে শব্দ শুনে সাধারণ মানুষ মনে করতে পারতো এখানে এমন নারীদের কথা বলা হয়েছে যারা কোন নারীর পরিচিত মহলের বা আত্মীয়-স্বজনদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ থেকে হয়তো বাঁদীরা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, এ ভুলধারণা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই বলে দিয়ে একথা পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে যে, স্বাধীন মেয়েদের মতো বাঁদীদের সামনেও সাজসজ্জার প্রদর্শনী করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় দলের মতে এ অনুমতিতে বাঁদী ও গোলাম উভয়েই রয়েছে। এটি হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) ও অন্য কতিপয় আহলে বায়েত ইমামের অভিমত। ইমাম শাফে’ঈর একটি বিখ্যাত উক্তিও এর সপক্ষে রয়েছে। তাদের যুক্তি শুধুমাত্র এর ব্যাপক অর্থ থেকে নয় বরং তারা সুন্নাতে রসূল থেকেও এর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করেন। যেমন এ ঘটনাটিঃ নবী ﷺ আবদুল্লাহ ইবনে মাস্আদাতিল ফাযারী নামক এক গোলামকে নিয়ে হযরত ফাতেমার বাড়িতে গেলেন। তিনি সে সময় এমন একটি চাদর গায়ে দিয়ে ছিলেন যা দিয়ে মাথা ঢাকতে গেলে পা খুলে যেতো এবং পা ঢাকতে গেলে মাথা খুলে যেতো। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হতবিহবল ভাব দেখে বললেন, “কোন দোষ নেই, এখানে আছে তোমার বাপ ও তোমার গোলাম।” (আবু দাউদ, আহমাদ ও বায়হাকী আনাস ইবনে মালেকের উদ্ধৃতি থেকে। ইবনে আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, নবী ﷺ হযরত ফতেমাকে এ গোলামটি দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একে লালন-পালন করেছিলেন এবং তারপর মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ উপকারের প্রতিদান সে এভাবে দিয়েছিলেন যে, সিফফীনের যুদ্ধের সময় হযরত আলীর প্রতি চরম শত্রুতার প্রকাশ ঘটিয়ে আমীর মু’আবিয়ার একান্ত সমর্থকে পরিণত হয়েছিল।) অনুরূপভাবে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তিটি থেকেও যুক্তি প্রদর্শন করেন-

যখন তোমাদের কেউ তার গোলামের সাথে “মুকাতাবত” তথা অর্থ আদায়ের বিনিময়ে মুক্তি দেবার লিখিত চুক্তি করে এবং চুক্তিকৃত অর্থ আদায় করার ক্ষমতা রাখে তখন তার সে গোলাম থেকে পর্দা করা উচিত।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ উম্মে সালামার রেওয়ায়াত থেকে।)

অধীনস্থ পুরুষদের যাদের অন্য কোন রকম উদ্দেশ্য নেই ৪৫
মূলে শব্দাবলী বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “পুরুষদের মধ্য থেকে এমন সব পুরুষ যারা অনুগত, কামনা রাখে না।” এ শব্দগুলো থেকে প্রকাশ হয়, মুহাররাম পুরুষদের ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সামনে একজন মুসলমান মহিলা কেবলমাত্র এমন অবস্থায় সাজসজ্জার প্...রকাশ করতে পারে, যখন তার মধ্যে দু’টি গুণ পাওয়া যায়, এক, সে অনুগত অর্থাৎ অধীনস্থ ও কর্তৃত্বের অধীন। দুই, তার মধ্যে কামনা নেই। অর্থাৎ নিজের বয়স, শারীরিক অসামর্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা, দারিদ্র ও অর্থহীনতা অথবা অন্যের পদানত হওয়া ও গোলামীর কারণে তার মনে গৃহকর্তার স্ত্রী, মেয়ে, বোন বা মা সম্পর্কে কোন কুসংকল্প সৃষ্টি হবার শক্তি বা সাহস থাকে না। এ হুকুমকে যে ব্যক্তিই নাফরমানীর অবকাশ অনুসন্ধানের নিয়তে নয় বরং আনুগত্য করার নিয়তে পড়বে সে প্রথম দৃষ্টিতেই অনুভব করবে যে, আজকালকার বেয়ারা, খানসাম, শোফার ও অন্যান্য যুবক কর্মচারীরা অবশ্য এ সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হবে না। মুফাস্সির ও ফকীহগণ এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তার ওপর একবার নজর বুলালে জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ এ শব্দগুলোর কি অর্থ বুঝেছেন তা জানা যেতে পারেঃ

ইবনে আব্বাসঃ এর অর্থ হচ্ছে এমন সব সাদাসিধে বোকা ধরনের লোক যারা মহিলাদের ব্যাপারে আগ্রহী নয়।

কাতাদাহঃ এমন পদানত ব্যক্তি যে নিজের পেটের খাবার যোগাবার জন্য তোমার পেছনে পড়ে থাকে।

মুজাহিদঃ এমন লোক যে ভাত চায়, মেয়েলোক চায় না।

শা’বীঃ যে ব্যক্তি কোন পরিবারের সাথে লেগে থাকে। এমনকি তাদের ঘরের লোকে পরিণত হয় এবং সে পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়। ঘরের মেয়েদের প্রতি সে নজর দেয় না এবং এ ধরনের নজর দেবার হিম্মতই করতে পারে না। পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই সে তাদের সাথে লেগে থাকে।

তাউস ও যুহ্রীঃ নির্বোধ ব্যক্তি, যার মধ্যে মেয়েদের প্রতি উৎসাহ নেই এবং এর হিম্মতও নেই।

(ইবনে জারীর, ১৮ খণ্ড, ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠা এবং ইবনে আসীর, ৩য় খণ্ড, ২৮৫ পৃষ্ঠা)

এ ব্যাখ্যাগুলোর চাইতেও বেশী স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। এটি ঘটেছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানায়। বুখারী, মুসলিম আবু দাউদ, নাসাঈ ও আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এটি হযরত আয়েশা (রা.) ও উম্মে সালামাহ (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন। ঘটনাটি হচ্ছেঃ মদীনা তাইয়েবায় ছিল এক নপুংশক হিজড়ে। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণ ও অন্য মহিলারা তাকে এর মধ্যে গণ্য করে নিজেদের কাছে আসতে দিতেন। একদিন নবী ﷺ উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামাহর কাছে গেলেন। সেখানে তিনি তাকে উম্মে সালামার (রা.) ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়ার সাথে কথা বলতে শুনলেন। সে বলছিল, কাল যদি তায়েফ জয় হয়ে যায়, তাহলে আপনি গাইলান সাকাফির মেয়ে বাদীয়াকে না নিয়ে ক্ষান্ত হবেন না। তারপর সে বাদীয়ার সৌন্দর্য ও তার দেহ সৌষ্ঠবের প্রশংসা করতে থাকলো এমনকি তার গোপন অংগগুলোর প্রশংসামূলক বর্ণনাও দিলে দিল। নবী ﷺ তা কথা শুনে বললেন, “ওরে আল্লার দুশমন! তুই তো তাকে খুবই লক্ষ্য করে দেখেছিস বলে মনে হয়।” তারপর তিনি হুকুম দিলেন, তার সাথে পর্দা করো এবং ভবিষ্যতে যেন সে গৃহে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর তিনি তাকে মদীনা থেকে বের করে দিলেন এবং অন্যান্য নপুংশক পুরুষদেরকেও অন্যের গৃহে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করে দিলেন। কারণ তাদেরকে নপুংশক মনে করে মেয়েরা তাদের সামনে সতর্কতা অবলম্বন করতো না এবং তারা এক ঘরের মেয়েদের অবস্থা অন্য ঘরের পুরুষদের কাছে বর্ণনা করতো। এ থেকে জানা যায়, কারো (কামনাহীন) হবার জন্য কেবলমাত্র এতটকুই যথেষ্ট নয় যে, সে শারীরিক দিক দিয়ে ব্যভিচার করতে সমর্থ নয়। যদি তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন যৌন কামনা থেকে থাকে এবং সে মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয় তাহলে অবশ্যি সে অনেক রকমের বিপদের কারণ হতে পারে।

এবং এমন শিশুদের সামনে ছাড়া যারা মেয়েদের গোপন বিষয় সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ। ৪৬
অর্থাৎ যাদের মধ্যে এখনো যৌন কামনা সৃষ্টি হয়নি। বড় জোর দশ-বারো বছরের ছেলেদের ব্যাপারে একথা বলা যেতে পারে। এর বেশী বয়সের ছেলেরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও তাদের মধ্যে যৌন কামনার উন্মেষ হতে থাকে।

তারা যেন নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। ৪৭
নবী(স.) এ হুকুমটিকে কেবলমাত্র অলংকারের ঝংকারের ...মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং এ থেকে এ নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, দৃষ্টি ছাড়া অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে উত্তেজিতকারী জিনিসগুলোও আল্লাহ তা’আলা মহিলাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যের প্রকাশনী করতে নিষেধ করেছেন তার বিরোধী। তাই তিনি মহিলাদেরকে খোশ্বু লাগিয়ে বাইরে বের না হবার হুকুম দিয়েছেন। হযরত আবু হুরাইরার (রা.) রেওয়ায়াত হচ্ছে, রসূলুল্লাহ(স.)বলেনঃ

“আল্লাহর দাসীদেরকে আল্লাহর মসজিদে আসতে নিষেধ করো না। কিন্তু তারা যেন খোশবু লাগিয়ে না আসে।” (আবু দাউদ ও আহমাদ) একই বক্তব্য সম্বলিত অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, একটি মেয়েটি মসজিদ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। হযরত আবু হুরাইরা (রা) তার পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। তিনি অনুভব করলেন মেয়েটি খোশ্বু মেখেছে। তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর দাসী! তুমি কি মসজিদ থেকে আসছো? সে বললো হ্যাঁ? বললেন ‘আমি আমার প্রিয় আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে মেয়ে মসজিদে খোশ্বু মেখে আসে তার নামায ততক্ষণ কবুল হয় না যতক্ষণ না সে বাড়ি ফিরে ফরয গোসলের মত গোসল করে।” (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ নাসাঈ)। আবু মূসা আশআরী বলেন, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

“যে নারী আতর মেখে পথ দিয়ে যায়, যাতে লোকেরা তার সুবাসে বিমোহিত হয়, সে এমন ও এমন। তিনি তার জন্য খুবই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ) তাঁর নির্দেশ ছিল, মেয়েদের এমন খোশ্বু ব্যবহার করা উচিত, যার রং প্রগাঢ় কিন্তু সুবাস হাল্কা। (আবু দাউদ)

অনুরূপভাবে নারীরা প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের আওয়াজ পুরুষদেরকে শোনাবে এটাও তিনি অপছন্দ করতেন। প্রয়োজনে কথা বলার অনুমতি কুরআনেই দেয়া হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণ নিজেরাই লোকদেরকে দ্বীনী মাসায়েল বর্ণনা করতেন। কিন্তু যেখানে এর কোন প্রয়োজন নেই এবং কোন দ্বীনী বা নৈতিক লাভও নেই সেখানে মহিলারা নিজেদের আওয়াজ ভিন্ পুরুষদেরকে শুনাবে, এটা পছন্দ করা হয়নি। কাজেই নামাযে যদি ইমাম ভুলে যান তাহলে পুরুষদের সুবহানাল্লাহ বলার হুকুম দেয়া হয়েছে কিন্তু মেয়েদেরকে এক হাতের ওপর অন্য হাত মেরে ইমামকে সতর্ক করে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)।

হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, ৪৮

অর্থাৎ এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি তোমরা করেছো তা থেকে তাওবা করো এবং ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল যেসব নির্দেশ দিয়েছেন সে অনুযায়ী নিজেদের কর্মপদ্ধতি সংশোধন করে নাও।

আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।৪৯
প্রসঙ্গত এ বিধানগুলো নাযিল হবার পর কুরআনের মর্মবা...ণী অনুযায়ী নবী ﷺ ইসলামী সমাজে অন্য যেসব সংস্কারমূলক বিধানের প্রচলন করেন সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্তসারও এখানে বর্ণনা করা সঙ্গত মনে করছিঃ

একঃ মুহাররাম আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে তিনি অন্য লোকদেরকে (আত্মীয় হলেও) কোন মেয়ের সাথে একাকী সাক্ষাত করতে ও তার কাছে নির্জনে বসতে নিষেধ করেছেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়াত হচ্ছে, নবী করীম ﷺ বলেছেনঃ

“যেসব নারীর স্বামী বাইরে গেছে তাদের কাছে যেয়ো না। কারণ শয়তান তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের রক্ত ধারায় আবর্তন করছে।” (তিরমিযী) হযরত জাবের থেকে অন্য একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কখনো কোন মেয়ের সাথে নির্জনে সাক্ষাত না করে যতক্ষণ না ঐ মেয়ের কোন মুহাররাম তার সাথে থাকে। কারণ সে সময় তৃতীয়জন থাকে শয়তান।”(আহমাদ)

প্রায় এ একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত তৃতীয় একটি হাদীস ইমাম আহমাদ আমের ইবনে রাবীআহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহর ﷺ নিজের সতর্কতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একবার রাতের বেলা তিনি হযরত সাফিয়ার সাথে তাঁর গৃহের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে দু’জন আনসারী তাঁর পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তাদেরকে থামিয়ে বললেন, আমার সাথের এ মহিলা হচ্ছে আমার স্ত্রী সাফিয়া। তারা বললেন, সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহর রসূল! আপনার সম্পর্কেও কি কোন কুধারণা হতে পারে? বললেন, শয়তান মানুষের মধ্যে রক্তের মতো চলাচল করে। আমার আশঙ্কা হলো সে আবার তোমাদের মনে কোন কুধারণা সৃষ্টি না করে বসে। (আবু দাউদ, সওম অধ্যায়)।

দুইঃ কোন পুরুষের হাত কোন গায়ের মুহাররাম মেয়ের গায়ে লাগুক এটাও তিনি বৈধ করেননি। তাই তিনি পুরুষদের হাতে হাত রেখে বাই’আত করতেন। কিন্তু মেয়েদের বাই’আত নেবার সময় কখনো এ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া... সাল্লামের হাত কখনো কোন ভিন্ মেয়ের শরীরে লাগেনি। তিনি মেয়েদের থেকে শুধুমাত্র মৌখিক শপথ নিতেন এবং শপথ নেয়া শেষ হলে বলতেন, যাও তোমাদের বাই’আত হয়ে গেছে।” (আবু দাউদ, কিতাবুল খারাজ)।

তিনঃ তিনি মেয়েদের মুহাররাম ছাড়া একাকী অথবা গায়ের মুহাররামের সাথে সফর করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। বুখারী ও মুসলিম ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ খুতবায় বলেনঃ

“কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাত না করে যতক্ষণ তার সাথে তার মুহাররাম না থাকে এবং কোন মহিলা যেন সফর না করে যতক্ষণ না তার কোন মুহাররাম তার সাথে থাকে।”

এক ব্যক্তি উঠে বললো, আমার স্ত্রী হজ্জে যাচ্ছে এবং আমার নাম অমুক অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেখা হয়ে গেছে। রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “বেশ, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জে চলে যাও।” এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বহু হাদীস ইবনে উমর, আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোতে শুধুমাত্র সফরের সময়সীমা অথবা সফরের দূরত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা আছে কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী মু’মিন মহিলার পক্ষে মুহাররাম ছাড়া সফর করা বৈধ নয়। এর মধ্যে কোন হাদীসে ১২ মাইল বা এর চেয়ে বেশী দূরত্বের সফরের ওপর বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে। কোনটিতে একদিন, কোনটিত এক দিন এক রাত, কোনটিতে দু’দিন আবার কোনটিতে তিন দিনের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিভিন্নতা এ হাদীসগুলোর নির্ভরযোগ্যতা খতম করে দেয় না এবং এ কারণে এর মধ্য থেকে কোন একটি হাদীসকে অন্য সব হাদীসের ওপর প্রাধান্য দিয়ে এ হাদীসে বর্ণিত সীমারেখাকে আইনগত পরিমাপ গণ্য করার চেষ্টা করাও আমাদের জন্য অপরিহার্য হয় না। কারণ এ বিভিন্নতার একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ বোধগম্য হতে পারে। অর্থাৎ বিভিন্ন সময় ঘটনার যেমন অবস্থা রসূলের (রা.) সামনে এসেছে সে অনুযায়ী তিনি তার হুকুম বর্ণনা করেছেন। যেমন কোন মহিলা যাচ্ছেন তিন দিনের দূরত্বের সফরে এবং এক্ষেত্রে তিনি মুহাররাম ছাড়া তাকে যেতে নিষেধ করেছেন। আবার কেউ এক দিনের দূরত্বের সফরে যাচ্ছেন এবং তিনি তাকেও থামিয়ে দিয়েছেন। এখানে বিভিন্ন প্রশ্নকারীর বিভিন্ন অবস্থা এবং তাদের প্রত্যেককে তাঁর পৃথক পৃথক জবাব আসল জিনিস নয়। বরং আসল জিনিস হচ্ছে ওপরে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতে যে নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি। অর্থাৎ সফর, সাধারণ পরিভাষায় যাকে সফর বলা হয় কোন মেয়ের মুহাররাম ছাড়া এ ধরনের সফর করা উচিত নয়।

মৌখিকভাবে এবং কার্যতও নারী ও পুরুষের মেলামেশা রোধ করার প্রচেষ্ট চালান। ইসলামী জীবনে জুম’আ ও জামা’আতের গুরুত্ব কোন ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির অজানা নয়। জুম্আকে আল্লাহ নিজেই ফরয করেছেন। আর জামা’আতের সাথে নামায পড়ার গুরু...ত্ব এ থেকেই অনুধাবন করা যেতে পারে যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন প্রকার অক্ষমতা ছাড়াই মসজিদে হাজির না হয়ে নিজ গৃহে নামায পড়ে নেয় তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি অনুযায়ী তার নামায গৃহীতই হয় না। আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারুকুত্নী ও হাকেম ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতের মাধ্যমে) কিন্তু নবী ﷺ জুম্আর নামায ফরয হওয়া থেকে মেয়েদেরকে বাদ রেখেছেন। (আবু দাউদ উম্মে আতীয়্যার রেওয়ায়াতের মাধ্যমে দারুকুত্নী ও বাইহাকী জাবেরের রেওয়ায়াতের মাধ্যমে এবং আবু দাউদ ও হাকেম তারেক ইবনে শিহাবের রেওয়ায়াতের মাধ্যমে) আর জামা’আতের সাথে নামাযে শরিক হওয়াকে মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক তো করেনইনি। বরং এর অনুমতি দিয়েছেন এভাবে যে, যদি তারা আসতে চায় তাহলে তাদেরকে বাধা দিয়ো না। তারপর এ সাথে একথাও বলে দিয়েছেন যে, তাদের জন্য ঘরের নামায মসজিদের নামাযের চেয়ে ভালো। ইবনে উমর (রা.) ও আবু হুরাইরার (রা.) রেওয়ায়াত হচ্ছে, নবী করীম ﷺ বলেছেনঃ (আরবী--) “আল্লাহর দাসীদেরকে আল্লাহ মসজিদে যেতে বাধা দিয়ো না।” (আবু দাউদ) অন্য রেওয়ায়াতগুলো বর্ণিত হয়েছে ইবনে উমর থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী এবং এর সাথে সামঞ্জস্যশীল শব্দাবলি সহকারেঃ

“মহিলাদেরকে রাতের বেলা মসজিদে আসার অনুমতি দাও।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ)

অন্য একটি রেওয়ায়াতের শব্দাবলি হচ্ছেঃ

“তোমাদের নারীদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না, তবে তাদের ঘর তাদের জন্য ভালো।” (আহমাদ, আবু দাউদ

উম্মে হুমাইদ সায়েদীয়া বলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আপনার পেছনে নামায পড়তে আমার খুবই ইচ্ছা হয়। তিনি বললেন, “তোমার নিজের কামরায় নামায পড়া বারান্দায় নামায পড়ার চাইতে ভালো, তোমার নিজের ঘরে নামায পড়া নিজের মহল্লার মসিজদে নামায পড়ার চাইতে ভালো এবং তোমা...র মহল্লার মসজিদে নামায পড়া জামে মসজিদে নামায পড়ার চেয়ে ভালো।” (আহমাদ ও তাবারানী) প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস আবু দাউদে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর হযরত উম্মে সালামার (রা.) রেওয়ায়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শব্দাবলী হচ্ছেঃ “মহিলাদের জন্য তাদের ঘরের অভ্যন্তর ভাগ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মসজিদ।” (আহমদ, তাবারানী) কিন্তু হযরত আয়েশা (রা.) বনী উমাইয়া আমলের অবস্থা দেখে বলেন, “যদি নবী ﷺ নারীদের আজকের অবস্থা দেখতেন তাহলে তাদের মসজিদে আসা ঠিক তেমনিভাবে বন্ধ করতেন যেমনভাবে বনী ইসরাঈলদের নারীদের আসা বন্ধ করা হয়েছিল। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ) মসজিদে নববীতে নারীদের প্রবেশের জন্য নবী ﷺ একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। হযরত উমর (রা.) নিজের শাসনামলে এ দরজা দিয়ে পুরুষদের যাওয়া আসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। (আবু দাউদ ই’তিযালুন নিসা ফিল মাসাজিদ ও মা জাআ ফী খুরুজিন নিসা ইলাল মাসাজিদ অধ্যায়) জামা’আতে মেয়েদের লাইন রাখা হতো পুরুষদের লাইনের পেছনে এবং নামায শেষে রসূলুল্লাহ ﷺ সালাম ফেরার পর কিছুক্ষণ বসে থাকতেন, যাতে পুরুষদের ওঠার আগে মেয়েরা উঠে চলে যেতে পারে। (আহমাদ, বুখারী উম্মে সালামার রেওয়ায়াতের মাধ্যমে) রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পুরুষদের সর্বোত্তম লাইন হচ্ছে তাদের সর্বপ্রথম লাইনটি এবং নিকৃষ্ঠতম লাইনটি হচ্ছে সবচেয়ে পেছনের (অর্থাৎ মেয়েদের নিকটবর্তী) লাইন এবং মেয়েদের সর্বোত্তম লাইন হচ্ছে সবচেয়ে পেছনের লাইন এবং তাদের নিকৃষ্টতম লাইন হচ্ছে সবার আগের (অর্থাৎ পুরুষদের নিকটবর্তী) লাইন। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও আহমাদ) দুই ঈদের নামাযে মেয়েলোকেরা শরীক হতো কিন্তু তাদের জায়গা ছিল পুরুষদের থেকে দূরে। নবী ﷺ খুতবার পরে মেয়েলোকদের দিকে গিয়ে তাদেরকে পৃথকভাবে সম্বোধন করতেন। (আবু দাউদ, জাবের ইবনে আবদুল্লার বর্ণনার মাধ্যমে বুখারী ও মুসলিম ইবনে আব্বাসের বর্ণনার মাধ্যমে) একবার মসজিদে নববীর বাইরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম দেখলেন, পথে নারী-পুরুষ এক সাথে মিশে গেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি নারীদেরেক বললেন,

“থেমে যাও, তোমাদের পথের মাঝখান দিয়ে চলা ঠিক নয়, কিনারা দিয়ে চলো।” এ কথা শুনতেই মহিলারা এক পাশে হয়ে গিয়ে একবারে দেয়ালের পাশ দিয়ে চলতে লাগলো। (আবু দাউদ)

এসব নির্দেশ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, নারী-পুরুষের মিশ্র সমাবেশাদি ইসলামের প্রকৃতির সাথে কত বেশী বেখাপ্পা! যে দ্বীন আল্লাহর ঘরে ইবাদাত করার সময়ও উভয় গোষ্ঠীকে পরস্পর মিশ্রিত হতে দেয় না তার সম্পর্কে কে ধারণা করতে পারে যে, সে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদ...ালত, ক্লাব-রেস্তরাঁ ও সভা-সমিতিতে তাদের মিশ্র হওয়াকে বৈধ করে দেবে?

পাঁচঃ নারীদেরকে ভারসাম্য সহকারে সাজসজ্জা করার তিনি কেবল অনুমতিই দেননি বরং অনেক সময় নিজেই এর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সীমা অতিক্রম করা থেকে কঠোরভাবে বাধা দিয়েছেন। সেকালে আরবের মহিলা সমাজে যে ধরনের সাজসজ্জার প্রচলন ছিল তার মধ্য থেকে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোকে তিনি অভিস্পাতযোগ্য এবং মানবজাতির ধ্বংসের কারণ হিসেব গণ্য করেছেনঃ

নিজের চুলের সাথে পরচুলা লাগিয়ে তাকে বেশী লম্বা ও ঘন দেখাবার চেষ্টা করা।

শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উল্কি আঁকা ও কৃত্রিম তিল বসানো।

ভ্রূর চুল উপড়ে ফেলে বিশেষ আকৃতির ভ্রূ নির্মাণ করা এবং লোম ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখ পরিষ্কার করা।

দাঁত ঘসে ঘসে সুঁচালো ও পাতলা করা অথবা দাঁতের মাঝখানে কৃত্রিম ছিদ্র তৈরী করা।

জাফরান ইত্যাদি প্রসাধনীর মাধ্যমে চেহারায় কৃত্রিম রং তৈরী করা।

এসব বিধান সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও আমীর মুআবীয়া (রা.) থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পরম্পরায় উদ্ধৃত হয়েছে।

আল্লাহ ও রসূলের এসব পরিষ্কার নির্দেশ দেখার পর একজন মু’মিনের জন্য দু’টোই পথ খোলা থাকে। এক, সে এর অনুসরণ করবে এবং নিজের ও নিজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে এমনসব নৈতিক অনাচার থেকে পবিত্র করবে, যেগুলোর পথরোধ করার জন্য আল্লাহ কুরআনে এবং তাঁর রসূল সুন্নাতে এমন বিস্তারিত বিধান দিয়েছেন। দুই, যদি সে নিজের মানসিক দুর্বলতার কারণে এগুলোর মধ্য থেকে কোনটির বিরুদ্ধাচরণ করে, তাহলে কমপক্ষে গোনাহ মনে করে করবে ও তাকে গোনাহ বলে স্বীকার করে নেবে এবং অনর্থক অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে গোনাহকে সওয়াবে পরিনত করার চেষ্টা করবে না। এ দু’টি পথ পরিহার করে যারা কুরআন ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে কেবল পাশ্চাত্য সমাজের পদ্ধতি অবলম্বন করেই ক্ষান্ত থাকে না বরং এরপর সেগুলোকেই যথার্থ ইসলাম প্রমাণ করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে দেয় এবং ইসলামে আদৌ পর্দার কোন বিধান নেই বলে প্রকাশ্যে দাবী করতে থাকে তারা গোনাহ ও নাফরমানীর সাথে সাথে মূর্খতা ও মুনাফিকসুলভ ধৃষ্টতাও দেখিয়ে থাকে। দুনিয়ায় কোন ভদ্র ও মার্জিত রুচি সম্পন্ন ব্যক্তি এর প্রশংসা করতে পারে না এবং আখেরাতে আল্লাহর কাছ থেকেও এর আশা করা যেতে পারে না। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মুনাফিকদের চাইতেও দু’কদম এগিয়ে আছে এমন সব লোক যারা আল্লাহ ও রসূলের এসব বিধানকে ভুল প্রতিপন্ন করে এবং এমন সব পদ্ধতিকে সঠিক ও সত্য মনে করে যা তারা অমুসলিম জাতিসমূহের কাছ থেকে শিখেছে। এরা আসলে মুসলমান নয়। কারণ এরপরও যদি তারা মুসলমান থাকে তাহলে ইসলাম ও কুফর শব্দ দু’টি একেবারেই অর্থহীন হয়ে যায়। যদি তারা নিজেদের নাম বদলে নিতো এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম থেকে বের হয়ে যেতো, তাহলে আমরা কমপক্ষে তাদের নৈতিক সাহসের স্বীকৃতি দিতাম। কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে, এ ধরনের চিন্তা পোষণ করেও তারা মুসলমান সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের চেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ সম্ভবত দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া যায় না। এ ধরনের চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী লোকদের থেকে যে কোন প্রকার জালিয়াতী, প্রতারণা, দাগাবাজী, আত্মসাত ও বিশ্বাসঘাতকতা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।
তোমাদের মধ্যে যারা একা ও নিসঙ্গ ৫০
একে সাধারণত লোকেরা নিছক বিধবা শব্দের অর্থে গ্রহণ করে থাকে। অথচ আসলে এ শব্দটি এমন সকল পুরুষ ও নারীর জন্য ব্যবহৃত হয় যারা স্ত্রী বা স্বামীহীন। শব্দটি এর বহুবচন। আর এমন প্রত্যেক পুরুষকে বলা হয় যার কোন স্ত্রী নেই এবং এমন প্রত্যেক নারীকে ব...লা হয় যার কোন স্বামী নেই। তাই আমি এর অনুবাদ করেছি “একা ও নিসঙ্গ।”

এবং তোমাদের গোলাম ও বাঁদীদের মধ্যে যারা সৎ ৫১

অর্থাৎ তোমাদের প্রতি যাদের মনোভাব ও আচরণ ভালো এবং যাদের মধ্যে তোমরা দাম্পত্য জীবন যাপনের যোগ্যতাও দেখতে পাও। যে গোলাম ও বাঁদীর আচরণ মালিকের সাথে সঠিক নয় এবং যার মেজায দেখে বিয়ের পরে জীবন সঙ্গীর সাথে তার বনিবনা হবে বলে আশাও করা যায় না তাকে বিবাহ দেবার দায়িত্ব মালিকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কারণ এ অবস্থায় সে অন্য এক ব্যক্তির জীবন নষ্ট করে দেবার জন্য দায়ী হবে। এ শর্তটি স্বাধীন লোকদের ব্যাপারে আরোপ করা হয়নি। কারণ স্বাধীন ব্যক্তির বিয়েতে অংশ গ্রহণকারীর দায়িত্ব আসলে একজন পরামর্শদাতা, সহযোগী ও পরিচিত করাবার মাধ্যমের বেশী কিছু হয় না। বিবাহকারী ও বিবাহকারিনীর সম্মতির মাধ্যমে আসল দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু গোলাম ও বাঁদীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে তোলার পূর্ণ দায়িত্ব হয় মালিকের। সে যদি জেনে বুঝে কোন হতভাগিনীকে একজন বদ স্বভাব ও বদচরিত্র সম্পন্ন লোকের হাতে তুলে দেয় তাহলে এর সমস্ত দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে।

ও বিয়ের যোগ্য তাদের বিয়ে দাও। ৫২
বাহ্যত এখানে আদেশমূলক ক্রিয়াপদ দেখে একদল আলেম মনে করেছেন, এ কাজটি করা ওয়াজিব। অথচ বিষয়টির ধরণ নিজেই বলছে, এ আদেশটি ওয়াজিব অর্থে হতে পারে না। একথা সুস্পষ্ট, কোন ব্যক্তির বিয়ে করানো অন্যদের ওপর ওয়াজিব হতে পারে না। কার সাথে কার বিয়ে করানো ...ওয়াজিব? ধরা যাক, যদি ওয়াজিব হয়ও তাহলে যার বিয়ে হতে হবে তার অবস্থা কি? অন্য লোকেরা যার সাথেই তার বিয়ে দিতে চায় তার সাথে বিয়ে কি তার মেনে নেয়া উচিত? এটি যদি তার ওপর ফরয হতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তার বিয়ে তার নিজের আয়ত্তে নেই। আর যদি তার অস্বীকার করার অধিকার থাকে তাহলে যাদের ওপর এ কাজ ওয়াজিব তারা কিভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে? এসব দিক ভালোভাবে বিবেচনা করে অধিকাংশ ফকীহ এ রায় দিয়েছেন যে, আল্লাহর এ উক্তি এ কাজটিকে ওয়াজিব নয় বরং “মান্দুব” বা পছন্দনীয় গণ্য করে। অর্থাৎ এর মানে হবে, মুসলমানদের সাধারণভাবে চিন্তা হওয়া উচিত তাদের সমাজে যেন লোকেরা অবিবাহিত অবস্থায় না থাকে। পরিবারে সাথে জড়িত লোকেরা, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহ নেবে এবং যার কেউ নেই তার এ কাজে সাহায্য করবে রাষ্ট্র্।
যদি তারা গরীব হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ আপন মেহেরবানীতে তাদেরকে ধনী করে দেবেন, ৫৩
এর অর্থ এ নয় যে, যারই বিয়ে হবে আল্লাহ‌ তাকেই ধনাঢ্য করে দেবেন। বরং এখানে বক্তব্য হচ্ছে, লোকেরা যেন এ ব্যাপারে খুব বেশী হিসেবী না বনে যায়। এর মধ্যে মেয়ে পক্ষের জন্যও নির্দেশ রয়েছে। বলা হয়েছে, সৎ ও ভদ্র রুচিশীল ব্যক্তি যদি তাদের কাছে পয়গা...ম পাঠায়, তাহলে নিছক তার দারিদ্র দেখেই যেন তা প্রত্যাখ্যান না করা হয়। ছেলে পক্ষকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কোন যুবককে নিছক এখনো খুব বেশী আয়-রোজগার করছে না বলে যেন আইবুড়ো করে না রাখা হয়। আর যুবকদেরকেও উপদেশ দেয়া হচ্ছে, বেশী সচ্ছলতার অপেক্ষায় বসে থেকে নিজেদের বিয়ের ব্যাপারকে অযথা পিছিয়ে দিয়ো না। সামান্য আয় রোজগার হলেও আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিয়ে করে নেয়া উচিত। অনেক সময় বিয়ে নিজেই মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীর সহায়তায় খরচপাতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। দায়িত্ব মাথার ওপর এসে পড়ার পর মানুষ নিজেও আগের চাইতেও বেশী পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। অর্থকরী কাজে স্ত্রী সাহায্য করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভবিষ্যতে কার জন্য কি লেখা আছে তা কেউ জানতে পারে না। ভালো অবস্থা খারাপ অবস্থায়ও পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে এবং খারাপ অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে ভালো অবস্থায়। কাজেই মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবী হওয়া উচিত নয়।

আল্লাহর বড়ই প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ। আরা যারা বিয়ে করার সুযোগ পায় না তাদের পবিত্রতা ও সাধুতা অবলম্বন করা উচিত, যতক্ষণ না আল্লাহ‌ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন। ৫৪
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী(স.) বলেনঃ

“হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে বিয়ে করতে পারে তার বিয়ে করে নেয়া উচিত। কারণ এ...টি হচ্ছে চোখকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার এবং মানুষের সততা ও সতীত্ব রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। আর যার বিয়ে করার ক্ষমতা নেই তার রোযা রাখা উচিত। কারণ রোযা মানুষের দেহের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে দেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ(স.) বলেনঃ

“তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব। এক ব্যক্তি হচ্ছে, যে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিয়ে করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, মুক্তিলাভের জন্য যে গোলাম লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তার মুক্তিপণ দেয়ার নিয়ত রাখে। আর তৃতীয় ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য বের হয়।” (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ।
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template