পৃথিবীতে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দু'টি শ্রেণীতে বিভক্ত। ধনী ও দরিদ্র। ধনীরা সাধারণত বিলাসবহুল পার্থিব শান্তিময় জীবনের অধিকারী। দরিদ্ররা অসচ্ছলতায় জীবনযুদ্ধে রত। কিন্তু তবু একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ধনীদের প্রাচুর্য গঠন ও সংরক্ষণে প্রয়োজন দরিদ্রদের শ্রম। আর দরিদ্রদের সাধারণ জীবন ধারণে প্রয়োজন ধনীদের সহানুভুতি। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, দরিদ্ররা সর্বদা ধনীদের অনুগ্রহপুষ্ট জীবনের ধারক।
ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য সম্পর্কে বিভিন্ন পার্থিব মতামত বিদ্যমান রয়েছে। কারো মতে, দরিদ্রতা আল্লাহ পাকের নির্ধারিত ভাগ্য। তাই একে নিয়ে দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। বরং এটা তাঁর প্রদত্ত একটি নেয়ামত। কারণ দরিদ্রতার মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তিই আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য শ্রেষ্ঠ সুযোগ লাভ করে থাকেন। তাদের মতে, অর্থ-বৈভব মানুষের মনকে আলস্নাহ পাকের স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এজন্য দরিদ্রতা বান্দার জন্য দুর্ভোগের কিছু নয়; বরং সৌভাগ্যের সোপান বলে তারা বিবৃতি প্রদান করে থাকেন।
আর একটি মতবাদী দল যারা জাবরিয়া বলে খ্যাত তাঁরা মনে করেন, আল্লাহ পাক ইচ্ছা করেই ধনী এবং দরিদ্র এ দু'টি শ্রেণী সৃষ্টি করেছেন। তিনি যদি অন্যরকম ইচ্ছা করতেন, অর্থাৎ যদি চাইতেন তাহলে সকল মানুষকে ধনী অথবা দরিদ্র করে সৃষ্টি করতেন। তা যে করেননি, এর উদ্দেশ্য রয়েছে। উভয় শ্রেণীকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহপাক এমনিভাবে সৃষ্টি করেছেন। সে পরীক্ষা হচ্ছে দরিদ্রদের প্রতি ধনীর কর্তব্য পরীক্ষা আর কষ্টের মধ্যে দরিদ্রের ধৈর্য পরীক্ষা। এ উভয় পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হতে পারলে আল্লাহপাকের তরফ হতে উভয়ের জন্য রয়েছে পরকালের জন্য পরম পুরস্কার। তাই জাবরিয়া মতবাদীদের মতে, আল্লাহর সৃষ্টি এই স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ ঘটানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। বরং বান্দার জন্য পাপ বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
আবার একদল মনে করেন, দরিদ্রতা একটি সমস্যা হলেও এনিয়ে ভাবনার কিছু নেই। কারণ এটি একটি অবশ্যই সমাধানযোগ্য সমস্যা! আর এ সমাধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় ধনীদের ওপর। ধনীরা তাদের সম্পদ হতে সাহায্য করবে দরিদ্রকে। এমনিভাবে দরিদ্রের দরিদ্রতা দূর হবে। কিন্তু এ মতবাদীরা শুধুমাত্র ধনীদের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করেন, দরিদ্রদের দায়িত্ব সম্পর্কে কিছুই বলেন না, বলেন না দরিদ্রতার মধ্যে দরিদ্রদের অল্পে তুষ্টি অথবা ধৈর্যশীলতার কথা। তাদের আরো অন্যান্য কর্তব্যবোধের কথা। ভবিষ্যৎ শুভ সংবাদের কথা। বরং বেশি বেশি করে বলেন, ধনীদের দায়িত্বশীলতার পারলৌকিক পুরস্কার আর দায়িত্বহীনতার পারলৌকিক শাস্তির কথা।
এর পর পুঁজিবাদী মতবাদ। পুঁজিপতিরা মনে করেন, যদিও দরিদ্রতা একটি মন্দ জিনিস, কিন্তু এজন্য ধনীরা অথবা রাষ্ট্র দায়ী নয়। দায়ী ওই দরিদ্র ব্যক্তি নিজে অথবা তার ভাগ্য। যে ভাগ্যের নির্মাতা স্রষ্টা স্বয়ং। আর তাই মেনেও দরিদ্রজনকে সাহায্য করতে কোনও ধনী বাধ্য নয়। কারণ, সাহায্য করে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না। তাছাড়া যেখানে সে দায়ী নয়, সেখানে কেন সে অনুরূপ ঝুঁকি অথবা দায়িত্ব নেবে। দায়িত্ব সে-ই নেবে, যে এর জন্য দায়ী। উলেস্নখ্য যে, ওপরে আলোচিত তিনটি মতবাদ অথবা ধারণা ইসলামী চিন্তাধারার সাথে কিয়দংশ মিল থাকলেও এই পুঁজিবাদী চিন্তাধারার সাথে বিন্দুমাত্র মিল নেই। সেকথা পরে আলোচনা করা হচ্ছে।
দরিদ্রতা সম্পর্কিত আর একটি মতবাদ কমিউনিজম। এই মতবাদটি পুঁজিবাদী মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কমিউনিস্টরা মনে করেন, দরিদ্রদের দরিদ্রতার জন্য পুরোপুরি দায়ী ধনী লোকরা তথা পুঁজিপতিরা। তারা অন্যায়ভাবে ধনের পাহাড় নির্মাণ করেন বলেই অন্যরা দরিদ্র হয়। এজন্য কমিউনিস্টরা দরিদ্রকে প্রভাবিত করেন ধনীদের বিরুদ্ধে, ধনীদের নিকট থেকে তাদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। এমনিভাবে তারা একটি সংগ্রামের সৃষ্টি করেন তাদের ভাষায়, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। শক্তিবলে তারা দরিদ্রদের ভাগ্য নির্মাণ করতে চান। স্রষ্টার আদর্শ অথবা ভূমিকাতে তারা আদৌ বিশ্বাসী নন। সমাজতন্ত্র নামে যে আর একটি মতবাদ আছে, তা কমিউনিজমেরই প্রায় সমরূপ। পার্থক্য শুধু এই যে, সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিস্টদের মত ধনিক শ্রেণীর উৎখাত চান না, বরং তাদের নিকট থেকে দরিদ্রদের ন্যায্য অধিকার দাবি করেন। আর তা অবশ্যই উপরোক্ত শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে নয়, যথাযথ নিয়মতান্ত্রিক পথে।
এখন দেখা যাক এ প্রসঙ্গে ইসলাম কি বলে।
আল-কোরানে নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ পাক বলেন- 'তোমরা জাহাদুল বালা (অর্থাৎ কম সম্পদ এবং অধিক সন্তান এমন অবস্থা) হতে আমার কাছে পানাহ (পরিত্রাণ) চাও।' রাসূল করীম (স.) এই বলে দোয়া করতেন-'আলস্নাহুম্মা ইনি্ন আউযুবিকা মিনাল কুফরী ওয়াল ফাকরী।' অর্থাৎ 'হে আল্লাহ! আমি কুফর, দরিদ্রতা এবং ক্ষুধা হতে নিশ্চয়ই তোমার কাছে পানাহ চাই।' তিনি এমনিভাবে আরো দোয়া করতেন-'আলস্নাহুম্মা ইনি্ন আউযুবিকা মিনাল ফাকরী ওয়াল কিলস্নাতি ওয়াজজিলস্নাতি।' অর্থাৎ 'হে আল্লাহ, আমি দরিদ্রতা, ক্ষুধা ও সম্পদের স্বল্পতা এবং জিলস্নাতি হতে তোমার কাছে নিশ্চয়ই পানাহ চাই।' এমনিভাবে দরিদ্রতা হতে পানাহ অর্থাৎ পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বান্দাদের প্রতি প্রার্থনার নির্দেশ আল-কুরআনে অসংখ্য আয়াতে আছে। নবী করীমের (স.) অনুরূপ অসংখ দোয়া আছে আল হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায়।
বলা হয়েছে 'পানাহ' অর্থাৎ পরিত্রাণ'। পরিত্রাণের প্রসংগ আসে যদি সেখানে থাকে মুসিবত বা বিপদ। এখানে দরিদ্রতা হতে পানাহ-এর কথা বার বার বলা হয়েছে। একসঙ্গে অনেক কিছু হতে পানাহ-এর কথা বিভিন্ন পৃথক আয়াতে বলা হলেও প্রায় সবগুলোতেই দরিদ্রতার কথা এসেছে বিশেষভাবে।
দরিদ্রতাকে কেন মুসিবত বলা হয়েছে? তার অবশ্য কারণ রয়েছে। অধিক দরিদ্রতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকলে কোনও মহৎকার্যে আত্মনিমগ্ন থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি এবাদত বন্দেগিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কঠিন দরিদ্রতার চিন্তা কোনো মহৎকার্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। হয়তো সেজন্যই নবী করীমকে (স.) চরম দরিদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সময় আলস্নাহ মা'বুদ তাঁকে হযরত খাদিজার (রা.) সম্পদ দিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন। এই প্রসংগে আল-কুরআনে রাসূলূল্লাহ কে (স.) উদ্দেশ্য করে এরশাদ করা হয়েছে- ওয়া ওয়াজাদাকা য়াইনাল ফা আগনা।' অর্থাৎ 'এই আল্লাহ আপনাকে অভাবগ্রস্ত পেয়েছিলেন, এরপর আপনাকে সম্পদশালী করে দিয়েছেন।' অবশ্য রাসূলূল্লাহ(স.) উক্ত সম্পদ কখনো নিজের ভোগের জন্য ব্যবহার করেননি।
বিশেষ করে যে সম্পদের প্রয়োজন হয় কখন কখন তার প্রমাণ হযরত আবু বকর (রা.)। হযরত আবু বকর (রা.) তৎকালীন আরবের সবচেয়ে ধণাঢ্য ব্যক্তি বলে গণ্য ছিলেন। তিনি তাঁর সকল সম্পদ ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তৎকালীন দরিদ্র সাধারণ মুসলমান জাতির জন্য এই সম্পদ অত্যন্ত উপকারী হয়। এ প্রসংগে নবী করীম (স.) আনন্দচিত্তে বর্ণনা করেন- ' মানাফায়ানি মালুন কামালি আবি বকরি'। অর্থাৎ 'আবু বকরের (রা.) সম্পদের মত আর কারো সম্পদ আমার উপকারে আসেনি।' অর্থাৎ সম্পদ থাকা ভাল, যদি তা সৎপথে উপার্জিত এবং সৎপথে ব্যয়িত হয়। হযরত রাসূলে পাক (স.) অনেক দোয়ার মধ্যে মানুষের জন্য স্বচ্ছতা, অর্থাৎ মানুষের দরিদ্রতা মুক্তির জন্য আলস্নাহর কাছে কামনা করতেন। সেকথা পূর্বেই উলেস্নখিত হয়েছে। হযরত আনাছ (রা.) ছিলেন রাসূলে পাকের (স.) একজন বিশ্বস্ত খাদেম। তিনি একজন দরিদ্র ব্যক্তি ছিলেন। রাসূলে পাক (স.) তাঁর জন্য এই বলে দোয়া করতেন-'আলস্নাহুম্মা তাকছির মানাহু।' অর্থাৎ 'হে আল্লাহ! তুমি তাকে (হযরত আনাছ (রা.) প্রচুর সম্পদ দাও।
-আ.শ.ম. বাবর আলী
Post a Comment