ইমাম হোসাইন (আ:) কারবালার প্রান্তরে কুফাবাসীদের উদ্দেশে বিশেষ করে ইয়াজিদের দল-বলের উদ্দেশে কয়েকটি ভাষণ বা খুতবা দেন। ইমাম পাক তার একটি ভাষণে বলেন- হে কুফাবাসী! আপনারা জানেন, ইয়াজিদ ও তার লোকজন আল্লাহর রাস্তা ত্যাগ করে শয়তানের রাস্তা ধরেছে। তারা পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ছড়াচ্ছে। তারা আল্লাহর সীমা লংঘন করে বায়তুল মালকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছে। তারা হালাল-হারামের ধার ধারে না। বন্ধুগণ! আপনারা এটা ভালোভাবেই জানেন, অন্যের চেয়ে খিলাফতের ওপর আমার হকই সর্বাধিক। আপনারা আমার কাছে কুফায় আসার জন্য বারবার চিঠি পাঠিয়েছেন এবং আমার প্রতি আনুগত্য শপথ (বাইয়াত) গ্রহণ করবেন বলে দূত পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছেন। জানিয়েছেন, আপনারা আমার সঙ্গ ত্যাগ করবেন না এবং আমার জীবনকে আপনাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান মনে করবেন।
হে কুফার বাসিন্দারা, আপনারা যদি আপনাদের ওয়াদার ওপর অটল থাকেন তবে হিদায়েত লাভ করবেন। আর যদি আপনারা তা মেনে না নেন এবং বাইয়াত ভঙ্গ করেন তাতেও আমি বিস্মিত হব না, কারণ আপনারা আমার পিতা মওলা আলীর সঙ্গে, আমার ভাই ইমাম হাসানের সঙ্গে এবং আমার চাচাতো ভাই হজরত মুসলিম বিন আকীলের সঙ্গে এর আগে এরকম ব্যবহার করেছেন। আপনারা তো আপনাদের আখিরাত নষ্ট করেছেন, সেই সঙ্গে অন্যকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। যারা ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে তারা আসলে নিজেদেরই ক্ষতি করে।
কারবালার মাঠে একে একে যখন সবাই শাহাদতবরণ করছে আর ইমাম হোসাইন সবার ছিন্ন লাশ মোবারক তুলে এনে তাঁবুতে রাখছেন। অবশেষে ইমাম পাক তাঁবু থেকে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে সর্বশেষ যে মর্মস্পর্শী ভাষণ দেনÑ হে লোক সকল! আপনারা তাড়াহুড়া ও গোলমাল করবেন না, শান্ত হন। আগে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে আমার ওপর যে দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে তা আমাকে পালন করতে দিন। এখানে আমি কেন এসেছি? কি জন্য এসেছি? তা আপনাদের জানা দরকার। আমার কথাগুলো যদি আপনাদের যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তবে তা গ্রহণ করবেন এবং আপনারা যদি আমার প্রতি সুবিচার করতে পারেন তবে সেটাই হবে আপনাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের কারণ। আর যদি আমার কথাগুলো মনঃপূত না হয় এবং আপনারা যদি ন্যায়বিচার করা থেকে বিরত থাকেন তাহলে আমার কিছু বলার থাকবে না। আপনারা তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। হে কুফার বাসিন্দারা, আপনারা আমার বংশীয় মর্যাদা সম্পর্কে চিন্তা করুন।
আপনারা ভাবুন আমি কে? মনের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। আমার মর্যাদাকে মাটিতে লুটিয়ে দেয়া কিংবা আমাকে হত্যা করা কি উচিত হবে? আমি কি প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি নই? আমি কি সাকিয়ে কাউসার মওলা আলীর পুত্র নই, যিনি বেহেশতে মুমিনদের কাউসারের পানি পান করাবেন? আমি কি জান্নাতের নেত্রী মা ফাতিমার সন্তান নই, যিনি সমগ্র নারী জাতিকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন? আপনাদের কি মনে নেই, নানা মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সেই পবিত্র বাণী : আমি ও আমার ভাই ইমাম হাসান বেহেশতি যুবকদের সর্দার ও ইমাম। আর বেহেশতে সব নর-নারীই হবেন যুবক-যুবতী। আমার এ কথাগুলো নিঃসন্দেহে সত্য। আমার কথাগুলো যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে আবু সাঈদ খুদরী (রা.), জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), আনাস ইবনে মালিক (রা.), জায়েদ ইবনে আকরাম (রা.), শোহায়েল ইবনে সাদ সাঈদী (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম যারা এখনও বেঁচে আছেন, যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে তা শুনেছেন তাদেরই না হয় জিজ্ঞাসা করুন। আমাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকার জন্য এ প্রমাণ কি যথেষ্ট নয়? আপনারাই বলুন, খোলা তরবারি নিয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করা আপনাদের কি উচিত হবে? ইমাম হোসাইনের কথাগুলো শুনে ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী মাথা নিচু করে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল। ইমাম পাক ইয়াজিদ বাহিনীর থেকে প্রতি উত্তর না পেয়ে অতঃপর বলেনÑ আল্লাহর কসম! আমি এখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একমাত্র জীবিত নাতি, আমি ছাড়া পৃথিবীতে নবীকন্যার কোন পুত্র বেঁচে নেই। তোমরা আমাকে হত্যা করতে জোট বেঁধেছ? আমি কি কাউকে হত্যা করেছি? আমি কি কারও প্রতি অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম করেছি? বিনা অপরাধে কেন আমাকে হত্যা করতে এসেছ? আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে? কি জবাব দেবে বিচার দিবসে নানা মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে? আমাকে সাহায্য করার মতো কি তোমাদের মধ্যে একজনও নেই? তোমরা কি আমর কথা শুনতে পাও না?
তোমাদের মাঝে কি একজন মুসলমানও নেই? ইতিহাস সাক্ষ্য ইয়াজিদের বাইশ হাজার সৈন্যবাহিনীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী কেউ ছিল না, সবাই ছিল কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক লেবাসধারী মুসলমান। তাই ইমাম পাক তার শেষ বাক্যে বুঝিয়ে দিলেন ইয়াজিদ বাহিনীতে আসল মুসলমান কেউ ছিল না সবাই ছিল নকল মুসলমান। এ ধরনের মুসলমানের নাজাতের কোন ব্যবস্থা নেই। খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.) বলেনÑ ‘বোকারা বুঝতে পারেনি, ইমাম হোসাইন পানির পিপাসায় অসহায়ের মতো মারা যায়নি বরং তিনি আসল ও নকলের ভাগটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেলেন। আসুন আমরা আসল হোসাইনী মুসলমান হই। হোসাইনী মুসলমান থেকেই জš§ নেবেন ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম।
Post a Comment