হজ্ব ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি। হজ্ব-এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা। পারিভাষিক অর্থে হজ্বের মাসে নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ শরীফ ও সংশিস্নষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি আলস্নাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করাকে হজ্ব বলা হয়। (কাওয়াইদুল ফিকাহ্)
হজ্বের রয়েছে দীর্ঘ পটভূমি। এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। বেহেশ্ত থেকে দুনিয়াতে আগমনের পর হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা পরস্পরকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তারা আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হন। তারই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আদম-সন্তানগণ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে। তারা তাদের হূদয়মন দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে।
এভাবে সাফা মারওয়ার মধ্যে সাঈ, মীনায় শয়তানকে কংকর মারা এবং কোরবানীর প্রেক্ষাপট, যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও বিবি হাজেরা এবং তাদের পূর্ণবান সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর দ্বারা রচিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে। এভাবে হযরত আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত সর্বযুগের আল্লাহপ্রেমিক, আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ নবী-রাসূল, ওলী-আবদাল তথা আল্লাহর নেকবক্ত বান্দাদের পরম ব্যাকুলতার সাথে আল্লাহর ঘর তাওয়াফের দ্বারা হাজার হাজার বছরের আত্মনিবেদনের মাধ্যমে রচিত হয়েছে হজ্ব। যিয়ারতের সুবিশাল প্রেক্ষাপট। সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ.) বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্ব আদায় করেছেন। এরপর হযরত নূহ (আ.) সহ অন্যান্য নবী-রাসূলরা সকলে বায়তুলস্নাহর যিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন।
হাদীসে বর্ণিত আছে, বায়তুলস্নাহ শরীফের পুনঃনির্মাণের কাজ সমাধা করার পর হযরত জিবরাঈল (আ.) হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে পবিত্র গৃহের তাওয়াফ ও হজ্ব করার জন্য বললেন। এ নির্দেশ পেয়ে হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) উভয়েই তাওয়াফসহ হজ্বের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমাধা করলেন। এরপর আল্লাহতা'আলা হুকুম করলেন, হে ইব্রাহীম! তুমি গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজ্বের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও। এবং মানুষের নিকট হজ্বের ঘোষণা দাও; তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হাজ্জ, ২২:২৭)
তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) একটি উঁচুস্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বামে পূর্ব-পশ্বিমে ফিরে হজ্বের ঘোষণা করলেন। বললেনঃ
'হে লোকেরা সকল! বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্ব তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের রবের আহ্বানে সাড়া দাও।' এ আহ্বান শুনে পূর্ব দিগন্ত হতে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত যাদের হজ্ব নসীব হবে তারা সকলেই 'হাযির হে প্রভু! আমরা সকলেই হাযির' বলেছে। কেউ সাড়া দিয়েছে একবার, আবার কেউ সাড়া দিয়েছে একাধিকবার। যারা একবার সাড়া দিয়েছে, তাদের একবার হজ্ব ভাগ্যে হয়। আর যারা একাধিকবার সাড়া দিয়েছে, তাদের একাধিক হজ্ব ভাগ্যে হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পর যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন তারা সকলেই বায়তুলস্নাহর যিয়ারত করেছেন, হজ্বব্রত পালন করেছেন। (আখবারে মক্কা, পৃঃ ৬৭-৬৮)
জাহিলিয়্যাতের যুগের লোকেরাও বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ এবং যিয়ারত করতো। কিন্তু তারা তা করতো নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে। নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার আলোকে জাহেলী বহু কর্ম তারা হজ্বের অন্তভুর্ক্ত করে নিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য হলো- হজ্বের মৌসুমে কুরায়শরা অন্যান্য হাজীদের ন্যায় আরাফায় না গিয়ে মুযদালিফায় অবস্থান করতো।
তারা বলতো আমাদের একটা স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য রয়েছে। তাই অন্যান্যদের মত আমরা সেখানে যেতে পারি না। ইসলাম জাহিলী যুগের এ সব কুসংস্কার চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে নতুনভাবে হজ্বের ফরজিয়াতের বিধান প্রবর্তন করে। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আলস্নাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্ব করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭)
মাওলানা শাহজাহান খান
Post a Comment