السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানির ঐতিহাসিক পটভূমি

| comments

একবার তিনি ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে আমার প্রতিপালক; আমাকে একটি সুসন্তান দান কর (সুরা সা-ফফা-তে ১০০ আয়াত) । কথায় বলে অন্তর থেকে যে কথা বের হয় তদ্বারা কাজ নিশ্চয়ই হয় । তাই ব্যথিতের ফরিয়াদ গ্রহণকারী আল্লাহ বললেন, অতপর আমিও তাকে (ইব্রাহীমকে) একটি ধৈর্যশীল ছেলে দান করার সুসংবাদ শুনিয়ে দিলাম (ঐ সুরা ১০১ )।

ছেলেটি যখন দৌড় ঝাপ করতে শিখলো এবং মুফাসসিরে কুরআন ফাররার মতানুযায়ী ছেলেটি যখন ১৩ বছর বয়সে পা দিল তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে স্বপ্নে হুকুম দেয়া হল যে, তুমি তোমার কলিজার টুকরা ইসমাইলকে আল্লাহর রাহে কুরবানি কর। মুকাতিল বলেন, এই স্বপ্ন তিনি উঠোউঠি তিন রাতেই দেখলেন। (ফাতহুল বায়ান, ৮ম খণ্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা)

জিলহজের ৮ম রাতে তিনি সর্ব প্রথম স্বপ্ন দেখেন যে, একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে যব্হ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর ঐ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এই চিন্তায় বিভোর থাকেন যে, এটা আল্লাহর তরফ থেকে সুস্বপ্ন, না দুঃস্বপ্ন। অতঃপর ৯ম রাতে তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। ফলে ঐ দিন তিনি জানতে ও বুঝতে পারেন যে, এটা স্বপ্ন। তারপর ১০ম রাতে তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। তাই ঐ দিনে তিনি কুরবানি করতে উদ্যত হন। পরপর তিনরাত স্বপ্ন দেখার পর তার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত তিনটি দিন বিশেষ নামে বিশেষিত হয়েছে। যেমন যুলহিজ্জার ৮ম দিনের নাম 'ইয়াওমুত তারভিয়াহ' বা চিন্তাভাবনার দিন। ৯ম দিনের নাম 'ইয়াওমুল আরাফাহ' বা জানার দিন। ১০ম দিনের নাম 'ইয়াওমুন নাহর' বা কুরবানির দিন। (তফসীরে কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৪৯ পৃষ্ঠা, তফসীরে বাগাভী ও খাযিন ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৩ পৃষ্ঠা, রূহুল মাআ-নী, ২৩ খণ্ড, ১২৮ পৃষ্ঠা)

এই স্বপ্ন দেখার পর ইব্রাহীম (আ:) পুত্রকে কুরবানি করার জন্য তৈরী হলেন এবং স্বীয় বিবি হাজেরাকে বললেন, ছেলেটাকে মুখহাত ধুইয়ে কাপড় পরিয়ে দাও। ওকে একটা কাজে নিয়ে যাব। একটি রিওয়ায়াত রয়েছে যে, যখন ইব্রাহীমকে কুরবানির স্বপ্ন দেখানো হয় তখন শয়তান মনে মনে বলে যে, এই সময় যদি আমি তাদেরকে ফেতনায় না ফেলতে পারি তাহলে আর কখনো পারবো না। অতঃপর দুই বাপ-বেটা যখন ঘর থেকে বের হলেন তখন শয়তান বিবি হাজেরার নিকটে গিয়ে হাযির হল এবং বললো, তোমার বেটাকে ইব্রাহীম কোথায় নিয়ে গেলেন:তিনি বললেন, কোন কাজে নিয়ে গেছেন। এবার শয়তান বলল, না না। তিনি তাকে কোন দরকারে নিয়ে যাননি বরং তাকে যবেহ করতে নিয়ে গেছেন। হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন, তিনি তাকে যবেহ করবেন কেন? শয়তান বললো-ইব্রাহীমের ধারণা যে, তার রব নাকি তাকে এই কাজের হুকুম দিয়েছেন। এ কথা শুনে হাজেরা বললেন, তাহলে তো তিনি তার পরওয়ারদেগারের হুকুম তামীল করে খুব ভাল কাজ করেছেন।

তার নিকট থেকে শয়তান নিরাশ হয়ে ফিরতে বাধ্য হলো। এখানে শয়তান নিরাশ হয়ে তাদের দু'জনের পেছনে ছুটলো তাদের কাছেও শয়তান পরাস্ত হলো। মিনায় পেঁৗছিয়ে ছেলেকে ইব্রাহিম (আ:) বললেন, প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি। অতএব এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ছেলেটি বললো, বাবা! আপনি তাই করুন আপনাকে যা হুকুম দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন (সূরা সা-ফফা-ত ১০২ আয়াত)।

এভাবে বাপ-বেটার সওয়াল জওয়াবের পর ছেলেটি যখন রাজি হয়ে গেল তখন দু'জনই আল্লাহর কাছে নিজেদের সঁপে দিল। কাতাদাহ বলেন, ছেলেটি জানদেনেওয়ালার সামনে তার জানের তোহফা পেশ কর্ল এবং তার বাপ নিজ কলিজার টুকরা ছিড়ে আল্লাহর সামনে রেখে দিল। (তফসীরে কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৫৩ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান, ৮ম খণ্ড, ৭১ পৃষ্ঠা)

ইবনুল মুনযির ও মুস্তাদরকে হাকিমে মুজাহিদ থেকে বর্ণনা রয়েছে যে, তারপর ছেলেটি তার বাপকে বললো, আপনি আমাকে চোখে দেখা অবস্থায় যবেহ করতে পারবেন না। কারণ, আপনার হয়তো ছেলের মায়া উথলে উঠতে পারে। ফলে আপনার ছুরি নাও চলতে পারে? কিংবা আমি হয়তো অধৈর্য হয়ে ছটফট করতে পারি এবং আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিতে পারি? সেজন্য আপনি আমার হাত থেকে ঘাড় পর্যন্ত কষে বেঁধে দিন। তারপর আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন।

অন্য বর্ণনায় আছে, ছেলেটি আবার বললো, বাবা! আপনি নিজের কাপড়টা সামলে নিন এবং আমাকে ভাল করে বেঁধে দিন। যাতে আমার রক্তের ছিটে আপনার গায় না লাগে এবং আমার নেকি কমে না যায়। আর যবহের পর আপনি যখন আমার মায়ের কাছে যাবেন তখন তাঁকে আমার সালাম দেবেন। আর আপনি যদি আমার জামাটা মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চান তাহলে নিয়ে যাবেন। যাতে তিনি কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। কলিজার টুকরা একমাত্র কচি বাচ্চার মুখ দিয়ে এরূপ কথা শুনে হযরত ইব্রহীমের মনে কি প্রতিক্রিয়াই না হতে পারে! তথাপি তিনি ধৈর্যের অটল পাহাড় হয়ে জওয়াব দিচ্ছেন, বাবা! তুমি আল্লাহর হুকুম পালনার্থে আমার কি উত্তম সাহায্যকারী! কথাটি বলে তিনি পুত্রকে চুমু খেলেন এবং ছলছল চোখে তাকে বাঁধলেন। (তফসীরে বাগাভী ও খাযেন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা এবং কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা) অতঃপর কুরআনের ভাষায়-

ইব্রাহীম তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। মুসনাদে আহমাদে একটি হাদীস রয়েছে যে, তখন ইসমাইলের গায়ে একটি সাদা জামা ছিল। তাই সে বললো, হে আব্বাজান! এটা ছাড়া আমার কাছে আর তো কোন কাপড় নেই যদ্বারা আপনি আমাকে কাফন দিতে পারেন। অতএব আপনি এই জামাটি খুলে নিন যাতে আমার কাফনের কাজ হয়ে যায়। সুতরাং তিনি জামাটা খুলে নিলেন। (ইবনে কাসীর ৪র্থ খন্ড ১৬ পৃষ্ঠা।)।

এবার শুরু হল আসল ঘটনা। অর্থাৎ ছেলেটির গলায় ছুরি চালাবার পালা। ইলাহী হুমুকের কাছে আত্মসমর্পণের মূর্ত প্রতীক ইব্রাহীমের হাত যখন ছেলেটির ঘাড়ে ছুরি চালিয়ে দিল ত্রিভুবন তখন কেঁপে উঠলো। সে কি অভিনব দৃশ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা তাও কে বলতে পারে। একদিকে জনমানবহীন পশুপক্ষী ও প্রাণীহীন মক্কা শহর। অন্যদিকে ধু ধু বালির মধ্যে খাঁ খাঁ করছে মিনার ঐতিহাসিক প্রান্তর। আর তারই মাঝে একটি ৯৯ বছরের বুড়ো বাপ এবং তার ছুরির তলায় পড়ে রয়েছে ১৩ বছরের ফুলস্ন কুসুমিত এক শিশুপুত্র। এই অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে আকাশ যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে এবং আদমের জন্মের সময় প্রবল আপত্তিকারী ফেরেশতারাও যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। গাছপালা কেউ আর নড়ছে না এবং পশু-পক্ষীরাও যেন চলাফেরা করতে পারছে না। বাতাসের গতিও যেন স্তব্ধ হয়ে গেল এবং পাহাড় ও পর্বতেও যেন একটা নিঝুমভাব ফুটে উঠলো। সবাই যখন বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখছে ইব্রাহীমের (আ.) হাত তখন ইসমাইলের গলায় অনবরত চলছে। কিন্তু বিধাতার লীলা বুঝা বড় ভার। তাই ইমাম সুদ্দী বলেনঃ এদিকে আল্লাহ ইব্রাহীম (আ.)কে হুকুম দিয়েছেন নিজহাতে ছেলে জবেহ কর, আর ওদিকে তিনি ছুরিকে নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি মোটেই কেটোনা। ফলে ছুরি এবং তার গলার মাঝখানে আল্লাহর কুদরতে একটি পিতলের পাত আড় সৃষ্টি করে। সেজন্য ইব্রাহীম বারবার ছুরি চালালেও কোন কাজ হচ্ছিল না। (ঐ ১৭ পৃষ্ঠা ও ফাতহুল বায়ান, ৮ম খন্ড, ৭২ পৃষ্ঠা)।

এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতিতে ত্রিভুবনের সবাই যখন হতভম্ব এবং হতবাক ও শ্বাসরুদ্ধ তখন আল্লাহ তার রহস্য ফাঁস করে দিয়ে জান্নাত থেকে জিব্রাইলের মাধ্যমে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসমাইলকে বাঁচিয়ে নিয়ে ইব্রাহীমের অজান্তে সেই দুম্বাটিকে তার দ্বারা জবেহ করিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন-

হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়েছো। আমি এভাবে (পরীক্ষার মাধ্যমে) নেক ও সৎ লোকদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিঃসন্দেহে এটাও একটা বিরাট পরীক্ষা। তাই আমি এক বিরাট কুরবানির বদলে তাকে (অর্থাৎ তোমার ছেলে ইসমাইলকে) বাঁচিয়ে নিয়েছি (সুরা সাফফা ত-১০৪-৭ আয়াত) ওয়াহিদী বলেনঃ ইবনে আব্বাসসহ অধিকাংশ মুফাসসিরীনের মতে ইব্রাহীমের নিকট সেই দুম্বাটি পাঠানো হয়েছিল যেটাকে জান্নাতে চলিস্নশ বছর ধরে লালন-পালন করা হয়েছিল। ( ফা, বা ৭৩ পৃষ্ঠা) কিন্তু ইবনে আবী হাতেম ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এটা সেই দুম্বা যেটা আদম (আ:) এর ছেলে (হাবীল) আল্লাহর দরবারে কুরবানি করেছিল এবং সেটা কবুলও হয়েছিল। তখন থেকে ওটা জান্নাতে চড়তে থাকে। পরিশেষে ওর দ্বারা আল্লাহ তাআলা ইসমাইলকে বাঁচিয়ে নেন। ইবনে কাসীর ৪র্থ খন্ড, ১৭ পৃষ্ঠা, কাবীর ৭ম খন্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা।

একটি বর্ণনায় আছে, ইব্রাহীম যখন ইসমাইলকে জবেহ করছিলেন তখন জিব্রাইল বলেছিলেন, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার এবং ইসমাইল বলেছিলেন লা ইলাহা ইলস্নালস্নাহ আল্লাহু আকবার। অতপর ইব্রাহীম (আ.) বলেন, আল্লাহু আকবার অলিলস্না হিল হামদ। তারপর থেকে এই তকবীরটা চিরস্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়। তফসীরে নাসাফী ৪র্থ খন্ড, ২০ পৃষ্ঠা কাশশাফ ৩য় খন্ড, ৩০৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে আবু সসউদ ৭ম খন্ড, ৫৪৮ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান, ৮ম খন্ড ৭৪ পৃষ্ঠা)।

জন্মদিন থেকে জীবনের ৯৯টি বছর ধরে একটার পর একটা পরীক্ষা করে যখন পরওয়ারদেগারে আলম ইব্রাহীমের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন তখন তার এই চিত্তহারী রোমাঞ্চকর ও বিপস্নব সৃষ্টিকারী কীর্তিকে কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষয় করে দিলেন এই বলে-

আমি তোমার এই সুমহান আদর্শকে পরবতর্ীদের জন্য চিরস্মরণীয় করে রাখলাম। তোমার এইসব কীর্তির দরুন তোমার প্রতি আমার রহমত ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক (সুরা সাফফা ত ১০৮ আয়াত)। অতপর আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক তখন থেকে চলে আসছে এই ইব্রাহীমী আদর্শের বাস্তবায়ন। তাই আজও লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর হুকুম তামীলের সাথে সাথে প্রতি বছর ইব্রাহীমের স্মৃতি পালন করে পাপমোচন সাগরে করছে অবগাহন।

গ্রন্থনা: মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
অধ্যাপক মাওলানা আইনুল বারী
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template