ব্যবহার মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার ও ইসলামী শরীয়াহ পরিপালন পরস্পর সহধর্মী। একটিকে ছাড়া অন্যটির কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই সকলকে অবশ্যই ইসলামী শরীয়ার আলোকে চরিত্র গঠন করতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে জগতের সকল মানুষ আমাদের নিকট সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। ইসলামে সুন্দর ব্যবহারকে ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয়। জনগণের প্রতি ভাল ব্যবহার আমাদের জীবনের অন্যতম ব্রত হওয়া উচিত। হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সাথে সকলকে গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। মানবসেবার জন্য উপস্থাপনের গুণ, দ্রুত ও ইতিবাচক সেবাদানের মানসিকতা থাকতে হয়। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির সমাবেশ ঘটিয়ে সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ ও অনৈতিক কাজের অস্তিত্ব রাখা যাবে না। ইসলামী জীবনাচার, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিজের জীবনে পরিপালন করতে হবে।
পরিপাটি হয়ে থাকা, মানানসই জামা-কাপড় পরা, চুল পরিপাটি করা, সালাম ও পরিচয় দেয়া, উত্তম আহার করা এবং অনুমতি নিয়ে কথা বলা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জীবন-যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সার্বজনীন শিষ্টাচার বা আদব-কায়দার সাধারণ মূলনীতির নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সর্বপ্রথমে ইসলামের মিশন এবং ভিশন সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। ইসলাম হলো একটি সেবার ধর্ম, অনুষ্ঠানস্বর্বস্বতাই যার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমরা পৃথিবীর সকল জনগণের সম্পদকে আমানত হিসেবে মনে করব। সর্বোত্তম মানবসেবা চালিয়ে যাওয়া আমাদের একটি মিশনারী দায়িত্ব। সেজন্য সেবাদানের ব্যাপারে মুমিনদের মধ্যে টিম স্পিরিট সৃষ্টি করতে হবে। ইসলাম হলো একটি সেবা প্রদানকারী ইন্ডাস্ট্রীর নাম। এজন্য আমাদেরকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে, যোগ্যতার মাধ্যমে, দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে জীবন-জগতের সেবা প্রদান করা উচিত। সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আনুগত্যতা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে। সেই সবচেয়ে ভাল মুসলমান, যার স্বভাব আপন পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভাল বলে বিবেচিত। সে-ই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, ওয়াদা পালন করে, দায়িত্ব পালন করে, মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সেই হলো প্রকৃত মুসলমান। খাঁটি মুসলিম সেই যার রসনা ও হাত থেকে মানব জাতি নিরাপদ। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্যে যা চাইবে তা অন্য ভাইয়ের জন্যেও চাইবে। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন- প্রত্যেকটি সৎ কাজই সদকা। হযরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানেরই সদকা করা অবশ্য কর্তব্য। উপস্থিত লোকজন বলল, যদি সে সদকা করার মত কিছু না পায়? তিনি বললেন, সে যেন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার না করে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন- ভাল কথা ও সদকা করা উত্তম কাজ। নবী করিম (সা.) আরও বলেন- তোমরা দোযখের আগুন থেকে বেঁচে থাক, একটি খেজুর দিয়ে হলেও। যদি তা না পাও তাহলে মধুর ভাষার বিনিময়ে। মানুষের মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম যার দ্বারা মানব কল্যাণ সাধিত হয়। সেই খাঁটি মানুষ যে তার ভাইকে রক্ষা করে উপস্থিত, অনুপস্থিত যে কোন অবস্থাতেই। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইবাদতের জন্য আর মানুষের সেবা ও সৃষ্টির খেদমতই হলো শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন- আল্লাহ সকল কাজে নম্রতা ভালবাসেন। হযরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুমিন মুমিনের জন্য ইমারতের ন্যায় যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবুত করে রাখে। তারপর তিনি হাতের আঙ্গুলগুলো আরেক হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকালেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার কোন প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এলো। নবী করিম (সা.) সাহাবীদের দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন, তোমরা তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা কর, এতে তোমাদের সওয়াব হবে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন- তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতা কর।
সালামের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। খুশি মনে সালামের জবাব দেয়া সকলের কর্তব্য। পরিচিত, অপরিচিত সকলকে সালাম দিতে হবে। সুযোগ পেলে মুসাফাহ করতে হবে। অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে পরিবারের লোকদেরও খোঁজ-খবর নেয়া যেতে পারে। মানুষকে আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাদের সাথে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতে হবে। রাসুল (সা.) সবসময় মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। সুতরাং বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিদ্বারা গ্রাহকদেরকে অভ্যর্থনা দিতে হবে। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সাথে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন- এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.) এর নিকট আরজ করল, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা আরজ করলে নবী করিম (সা.) প্রত্যেকবারই বললেন রাগ করো না। আমাদের সমাজে একটি কথার প্রচলন করা যেতে পারে - রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। সর্বসাধারণের সাথে কখনও তর্কে অবতীর্ণ হওয়া যাবে না।
মুসলমানরা ইহজাগতিক স্বার্থে কোন নেক কাজ করে না, দুর্নীতিমুক্ত জীবন গড়ে তোলে ও ব্যবসায়িক অসাধুতা উচ্ছেদ করে, দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে, পবিত্র পরিবেশ গড়ে তোলে, যাকাতভিত্তিক সমাজ কায়েমের মাধ্যমে দারিদ্র্যের উপর ইসলামের বিজয় সাধন করে। সমাজ গড়ার কাজে উপযুক্ত হবার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে- সৎ ও যোগ্য হওয়া। তাই পৃথিবীকে গড়ার আগে সবার আগে নিজকে গড়তে হবে। সমাজকে এমন পবিত্র করে গড়ে তোলা যাতে সহজেই সব মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সুন্দর ব্যবহার হাসিল করার সুযোগ পায়। এ বিষয়ে মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনাদর্শকে অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের মুক্তিকে জীবনের চরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হবে। সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে পার্থিব জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি চিরন্তন জীবনের মহাশান্তি লাভের পথ সুগম করা স্মভব। মুমিনমাত্রই মানবীয় আকর্ষণের সকল বেড়াজাল ছিন্ন করে ও বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জাগ্রত হয় প্রকৃত আল্লাহর বান্দাহরূপে। এভাবে একজন সফল বান্দাহ আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
**মোহাম্মদ সদরুল আমীন রাশেদ**
Post a Comment