২০১০ সাল এক স্মরণীয় ঐতিহ্যের নিরব সাক্ষী। ঠিক এক হাজার চারশ’ বছর পূর্বে ৬১০ খ্রী:-এর রমজান মাসে নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ অহংকার, সর্বকালের সব সমস্যার সমাধান- মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমজানের শ্রেষ্ঠতম রজনী ‘লাইলাতুল ক্বদরে’ সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় অবতীর্ণ হয়। স্বয়ং আল্লাহ বলেন, “মহিমান্বিত রমজান মাস, এতে মানব জাতির পথ প্রদর্শক এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” (সুরা বাকারা : ১৮৫)
পবিত্র রমজান হল মহান আল্লাহর অফুরন্ত দয়া ও অনুগ্রহের মাস। এতে ইবাদত ও আত্মশুদ্ধিতে বান্দা সারা বছর পরিশীলিত জীবনবোধের প্রশিক্ষণ লাভ করে। এ মাসের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হল ঃ যাতে তোমরা ধর্মভীরুতা অর্জন করতে পার।” (সুরা বাকারা: ১৮৩)
ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম ‘সাওম’ বা রোজা। আত্মিক অনুভূতি সৃষ্টি এবং জৈবিক লালসা নিয়ন্ত্রণে রোজা খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কৃচ্ছ্রতা নিশ্চিত করে। আদর্শ চরিত্র আর পবিত্র আবহ বিনির্মাণে রোজার তুলনা হয় না। এজন্যই মহান আল্লাহর নির্দেশ, “তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পায়, সে যেন রোজা রাখে।” (সুরা বাকারা-১৮৫) তাই শরীআতসম্মত কারণ ছাড়া রোজা ত্যাগের সুযোগ নেই। আর আহার-বিহারে সময় পরিবর্তন তথা দিনকে রাত ও রাতকে দিন করবার নাম রোজা নয়; বরং রোজার উদ্দেশ্য হল আল-কোরআনের শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। তাই রমজানের প্রতিটি তৎপরতার উদ্দেশ্য হতে হবে কল্যাণময়। বিশেষতঃ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ভোগ ও ব্যবহারে সংযমী হওয়া একান্ত করণীয় - যেন একজনের ভোগ, অন্যের ভোগান্তির কারণ না হয়।
রমজান মাস শুধুই কোরআন নাজিলের মাস নয়- এ মাসেই সব আসমানী কিতাব নাযিল হয়। যথা যাবুর-০৬ রমজান, তাওরাত-০১ রমজান, ইঞ্জিল-১২ রমজান ও পবিত্র কুরআন কদরের রাতে নাজিল হয়।
বিশ্বমানবতার অস্থির ও অশান্ত প্রেক্ষাপটে প্রিয়নবী (সা.) নিরব, নিভৃত, ধ্যানমগ্ন একাকীত্ব অবলম্বন করেন। তখনই তিনি অদৃশ্য ধ্বনী শুনতে পেতেন- “ইয়া মুহাম্মদ আনতা রাসুলুল্লাহ।” হে মুহাম্মদ (স.) আপনি আল্লাহর রাসুল) আর যখন তাঁর বয়স ৪০ পূর্ণ হয় তখন ৬১০ খ্রী: এ সর্বপ্রথম হেরা পর্বতের গুহায় ওহী নাজিলের সূচনা হয়।
বিশুদ্ধ হাদীস সংকলন বুখারি শরীফে এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা.) এর বর্ণনায় জানা যায়, সে সময় রাসুল (সা.) এর স্বপ্ন দিবালোকের মত সত্য হয়ে যেত এবং তিনি নির্জন ইবাদতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তখন হেরা গুহায় জিব্রাইল (আ.) তাঁকে বললেন, পাঠ করুন! তিনি (স.) বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিব্রাইল (আ.) তাঁর সাথে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন, “পাঠ করুন!” তিনি একই উত্তর দিলেন। এরূপ তিনবারের মাথায় তিনি উচ্চারণ করলেন- “পাঠ করুন, আপনার প্রভুর নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেনঃ তিনি মানুষকে তাই শিখিয়েছেন যা সে জানত না।” (সুরা আলাক ০১-০৫)
আল-কোরআন নাযিলের সূচনাপর্ব অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং দীর্ঘ তেইশ বছরের পথ পরিক্রমায় সুরা মায়েদার ০৩ নং আয়াতের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে।
আত্মশুদ্ধির জন্য ‘ভোজনে কৃচ্ছ্রতা সাধন’ আবহমান ঐতিহ্যে সব ধর্মে স্বীকৃত। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকা’ গ্রন্থে আছে - “প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, এমন কি গ্রীক ও পারসিক ধর্মে উপবাস প্রথার প্রচলন ছিল। ঃ পৃথিবীর এমন কোন ধর্মমত খুঁজে পাওয়া যাবে না যাতে উপবাস রীতির প্রচলন নেই।” তাই ইসলামেও ৬২৪ খ্রী: রমজানের রোজা ফরজ করা হয়। আর এ রমজান মাসেই কোরআন নাজিল হয়।
অধ্যাপক মো: আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
Post a Comment