السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

রোজাদারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ

| comments

পবিত্র রমজান পালনকারী রোজাদারদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু বিষয় রয়েছে যা না মেনে চললে রোজার সওয়াব হতে বঞ্চিত হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। সে সমস্ত বিষয় হাদীসের আলোকে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হলো-
সিয়াম পালনকারীর পরনিন্দা ও মিথ্যা বলা অবৈধ

সিয়াম পালন করা অবস্থায় পেট খালি থাকে বলে কোন কোন সিয়াম পালনকারীর মধ্যে আলস্য ভাব দেখা দেয়। তখন তারা কখনো বিভিন্ন গল্প-গুজবে মত্ত হয় এবং ঐ গল্পের মধ্যে কখনো সে কারো নিন্দা করে ফেলে এবং মিথ্যাও বলে। তাই এরূপ সিয়াম পালনকারী সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেন: যুদ্ধের জন্য তোমাদের কারো যেমন ঢাল থাকে, তেমনি সিয়ামও জাহান্নামের আগুনের ঢালস্বরূপ। (নাসাঈ ১ম খণ্ড- ২৪১ পৃ:)

হযরত নবী করীম (স.) বলেন: সিয়াম ঢালস্বরূপ যতক্ষণ না তাকে মিথ্যা কিংবা পরনিন্দা দ্বারা ভেঙ্গে ফেলা হয়। (তাবারানী আওসাত, জামে সগীর- ২য় খণ্ড- ৫১ পৃ:)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একবার দু’জন লোক জোহর কিংবা আসরের নামাজ পড়ল। তারা দু’জনই সিয়াম পালনকারী ছিল। হযরত নবী করীম (স.) যখন নামাজ শেষ করলেন তখন ঐ দু’জনকে বললেন, তোমরা পুনরায় ওযু কর ও নামাজ আবার পড় এবং রোজা এখনও চালিয়ে যাও। কিন্তু অন্য দিনে এ সিয়াম দু’টি কাযা করে দিও। তারা বললেন, কেন হে আল্লাহর রাসুল (স.)? তিনি (স.) বললেন: তোমরা অমুকের গীবত ও নিন্দা করেছ (তাই এ শাস্তি)। (বায়হাকীর শুআবুল ঈমান, মিশকাত-৪১৫ পৃ:)। উক্ত হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, রোজা অবস্থায় পরনিন্দা ও মিথ্যা কথা বললে রোজা নষ্ট হতে পারে। এজন্য অন্য হাদীসে হযরত নবী করীম (স.) বলেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও অশ্লীল কাজ করা ছাড়লো না তার খাওয়া ও পান ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজনই নেই। (বুখারী, ২৫৫ পৃ:, তিরমিযী ১ম খণ্ড- ৮৯ পৃ:, আবু দাউদ-১ ইবনে মাজা, মিশকাত, বুলুগুল মারাম ইবনে খুযায়মা)

এজন্য আর এক হাদীসে রাসুল (স.) বলেন: অনেক রোজা পালনকারী এমন আছে যার রোজা দ্বারা পিপাসিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না এবং অনেক রাতের সালাত আদায়কারী এমন আছে যাদের রাতে সালাতে দাঁড়ানো দ্বারা কেবল রাত জাগা ছাড়া আর কিছুই হয় না। (দারেমী, মিশকাত ১৭৭ পৃ:)। অপরদিকে সিয়াম অবস্থায় পরনিন্দা না করার ভাল সম্পর্কে এক তাবেঈ আবুল আলিয়াহ (রহ.) বলেন, সিয়াম পালনকারী ততক্ষণ ইবাদাতের মধ্যে থাকে যতক্ষণ সে কারো গীবত না করে। যদিও সে তার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে।

সিয়াম পালনকারীর বমি হলে বা করলে

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: যে সিয়াম পালনকারীর অনিচ্ছাকৃত বমি হয় তার উপর কাযা রোজা নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করল সে যেন ঐ সিয়ামটা কাযা করে দেয়। (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত, ১৬৭ পৃ:)।

সিয়াম পালনকারীর থুথু গেলা

সিয়াম অবস্থায় পেট খালি থাকে বলে কারো থুথু খুব বেশী আসে। তাদের সম্পর্কে কাতাদাহ (রা.) বলেন, সিয়াম পালনকারীর থুথু গিলতে কোন আপত্তি নেই। (মুসান্নাফ আ: রাযযাক ৪র্থ খণ্ড-২০৫ পৃ:)

এ ব্যাপারে আতা (রহ.) বলেন, কেউ যদি কুলি করে মুখের সব পানি ফেলে দেয়, তারপর সে যদি থুথু এবং মুখের ভেতরে যা ছিল তা গিলে নেয় তাতে কোন অসুবিধা নেই। (বুখারী তর্জমাতুল বা-ব, ২৫৯ পৃ:)

থুথু হল মুখের আঠা। সেজন্য থুথু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তা গিলে ফেলা যাবে, কিন্তু অনেক থুথু জমা করে ঢোক গেলা যাবে না।

সিয়াম পালনকারীর কিছু চাখার মাস‘আলা

যেসব রোজাদার রান্নার কাজ করেন, কখনো কখনো তারা ঝাল, লবণ ও মিষ্টি প্রভৃতি চাখতে বাধ্য হন। তাদের সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সিয়াম পালনকারীর জন্য কোন হাঁড়ির কিংবা কোন জিনিস চাখায় আপত্তি নেই। (বুখারী তর্জমাতুল বা-ব, ২৫৮ পৃ:)।

হাসান (রহ.) সিয়াম অবস্থায় কিছু চিবিয়ে তা মুখ থেকে বের করে নিজ শিশুর মুখে দিতেন। (মুসান্নাফ আ: রাযযাক, ৪র্থ খণ্ড- ২০৭ পৃ:)

সিয়াম পালনকারীর নাকে, চোখে ও কানে ওষুধ দেয়ার মাস’আলা

হাসান (রহ.) বলেন, রোজাদারের জন্য নাকে ওষুধ দেয়াতে আপত্তি নেই যদি তা খাদ্যনালী পর্যন্ত না পৌঁছে। (বুখারী, তর্জমাতুল বা-ব, ২৫৯ পৃ:)। ওজু করা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে নাকে পানি ঢুকে যায় তাতেও কোন আপত্তি নেই। (ফতহুল বারী ৪র্থ খণ্ড, ১৫৯) হাসানের মতে, সিয়াম পালনকারীর চোখে ওষুধ দিতে কোন বাধা নেই। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ৩য় খণ্ড- ৪৯ পৃষ্ঠা) কানে তেল কিংবা পানি দেয়া এবং কাঠি প্রবেশে আপত্তি নেই। (রমজানুল মুবারক কে ফাযায়েল ও আহকাম ২১ পৃষ্ঠা)

রোজা অবস্থায় মিসওয়াক করা

আমের ইবনে রবীয়াহ (রা.) বলেন, আমি হযরত নবী করীম (স.)-কে অসংখ্যবার সিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক করতে দেখেছি। (তিরমিযী, আবু দাউদ, মিশকাত) এক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: সিয়াম পালনকারীর উত্তম অভ্যাসের একটি অভ্যাস মিসওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ, ১২২ পৃ: বায়হাকী ৪র্থ খণ্ড, ২৭২ পৃ:)

রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেলে

কেউ যদি রমজান মাসে বিনা কারণে সিয়াম না রাখে কিংবা রেখেও বিনা কারণে ইচ্ছাকৃত রোজা ভেঙ্গে দেয় তার শাস্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: যে ব্যক্তি বিনা কারণে ও বিনা অসুখে রমজানে খাওয়া-দাওয়া করে তার তরফ থেকে আজীবন সিয়াম ও ঐ সিয়ামের কাফফারা হবে না। (তিরমিযী ১ম খণ্ড- ৯০ পৃ:, আবু দাউদ ১ম খণ্ড- ৩২৬ পৃ:, আহমাদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত- ১৭৭ পৃ:)

সিয়াম পালনকারীর ঝগড়া

সিয়াম পালন করা অবস্থায় পেট খালি থাকে বলে পিত্ত সতেজ হয়। ফলে কোন কোন সিয়াম পালনকারীর মেজাজ উগ্র হয়ে যায়। তাই সে কখনোও ঝগড়ায় মত্ত হয়। এরূপ সিয়াম পালনকারী সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: তোমাদের কেউ যখন রোজা অবস্থায় থাকবে তখন সে যেন বলে যে, আমি রোজাদার। (বুখারী- ২৫৪ পৃ:, মুসলিম ১ম খণ্ড, ৩৬৩ পৃ:)

অন্য হাদীসে হযরত নবী করীম (স.) বলেন: সিয়াম অবস্থায় তুমি আপোষে গালিগালাজ করো না। যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় তাহলে তুমি বল যে, আমি রোজাদার। আর তখন তুমি যদি দাঁড়িয়ে থাক তাহলে বসে পড়। (সহীহ ইবনে খুযায়মা, ৩য় খণ্ড, ২৪১ পৃ:)

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, কেবল খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম নয়। বরং রোজা হল আজেবাজে কথা বলা ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা। অতএব যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সাথে একগুয়েমি মূর্খতার পরিচয় দেয় তাহলে তোমার বলা উচিত যে, আমি রোজা আছি। (ইবনে খুযায়মা, ৩য় খণ্ড ২৪২ পৃ:)

এ হাদীসটির ব্যাখ্যায় বিখ্যাত সাহাবী জাবের (রা.) বলেন, যখন তুমি রোজা থাকবে তখন তুমি তোমার কান, চোখ ও জিহ্বাকে মিথ্যা ও পাপ থেকে বিরত রাখবে এবং চাকর-বাকরদের কষ্ট দেয়া ছেড়ে দেবে। আর তোমার মধ্যে যেন রমজানের গাম্ভীর্য ও শান্তভাব ফুটে উঠে। আর তুমি তোমার রোজাহীন দিন ও রোজা রাখার দিনকে সমান করো না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা- ৩য়, ৩ পৃ:)

রোজা অবস্থায় যা যা করা যায় হযরত নবী করীম (স.) কখনো রোজা অবস্থায় পিপাসার কারণে কিংবা রোজার তাপের দরুন নিজের মাথায় পানি ঢালতেন। (আবূ দাউদ মিশকাত ১৭৭ পৃ:)। আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, একজন লোক হযরত নবী করীম (স.) কে কোন রোজাদারের নিজের স্ত্রীর সাথে আলিঙ্গন করার কথা জিজ্ঞেস করলো। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। তারপর আর একজন এসে তাঁকে ঐ একই প্রশ্ন করলো। তিনি তাকে তা করতে নিষেধ করলেন। যাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল, সে ছিল বৃদ্ধ লোক এবং যাকে নিষেধ করা হয়েছিল, সে ছিল যুবক। (আবূ দাউদ, ১ম খণ্ড- ৩২৪ পৃ:, মিশকাত-১৭৬ পৃ:)

গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণীর সিয়াম

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: মুসাফির ও দুগ্ধদানকারিণী এবং গর্ভবতী নারীর উপর থেকে আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা সিয়াম সরিয়ে দিয়েছেন। (আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত-১৭৮ পৃ:)। গর্ববতী ও দুগ্ধদানকারিণীর ব্যাখ্যায় অন্য এক হাদীসে আনাস (রা.) বলেন, সেই গর্ভবতীকে রোজা না রাখার অনুমতি দিয়েছেন যে নারী তার সন্তানের ব্যাপারে ভয় পেয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ, ১২১ পৃ:)

রোগীর সিয়াম

আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন: যে ব্যক্তি (রমজান মাসে) রোগী থাকবে সে রমজানের পর অন্যান্য দিনগুলোতে সিয়াম রাখবে। (সূরা বাকারা ২ : ১৮৫ আয়াত)

এ ব্যাপারে হযরত নবী করীম (স.) বলেন: যে ব্যক্তি রমজানে অসুখে পড়লো, অতঃপর সে রোগীই থাকল, পরিশেষে মারা গেল, তার পক্ষ থেকে মিসকীন খাওয়াতে হবে না, যদি সে সুস্থ হয়ে যায়, তারপরও সে কাযা সিয়াম না রেখে মারা যায় তাহলে তার তরফ থেকে মিসকিন খাওয়াতে হবে। (মুসান্নাফ আ: রাযযাক ৪র্থ খণ্ড, ২৩৭ পৃ:) আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন, আমীন।

গ্রন্থনা
০০ মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template