লিখেছেন: আবুল কাশেম ও মফিজ উদ্দিন
যে কোন ইবাদতে আল্লাহকে হাজের-নাজের জ্ঞান করা অপরিহার্য। মহানবী (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর ইবাদত তুমি এমনভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাকে না দেখ, তবে মনে করবে তিনি তোমাকে দেখছেন।” উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, প্রথমে ‘দর্শন’, তারপর মন বা অন্তর, অর্থাৎ বাহ্যিক দৃষ্টিতে মহান আল্লাহকে দেখা না গেলেও তিনি বান্দার সবকিছু দেখেন। এরূপ মনে করার মধ্যেই বান্দার সামনে আল্লাহর হাজের-নাজের থাকার ধারণা সৃষ্টি করতে হবে।
ইবাদতে আল্লাহর উপস্থিতির ধারণা ছাড়া ইবাদত হয়ে পড়ে প্রাণহীন ও নিষ্ফল। সুতরাং মহান আল্লাহকে হাজের-নাজের জেনে ইবাদত করার মধ্যেই ইবাদতের সাফল্য নিহিত।
ইবাদতরত অবস্থায় বান্দার মনে এ ধারণাই বদ্ধমূল হতে হবে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার সামনে এবং বান্দা একান্ত নিবেদিত প্রাণে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদতে মশগুল। যে ইবাদতে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে এভাব প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যমান থাকে। সেই ইবাদতই আল্লাহর পছন্দনীয় এবং কবুলিয়তের মর্যাদা লাভ করে। অন্য যে কোন ইবাদতের তুলনায় নামাযের মধ্যে মহান আল্লাহর বিরাজমানতার জ্ঞান সবচেয়ে বেশি হওয়া প্রয়োজন।
মূলত তিনটি জিনিসের দ্বারা নামায পড়া হয়। যথাঃ (১) মন বা অন্তর দ্বারা আল্লাহর সামনে দীনতা ও হীনতা প্রকাশ করা, (২) মুখ বা জবান দ্বারা আল্লাহ্র যিকির করা, (৩) দেহ বা শরীর দ্বারা আল্লাহকে তাজিম ও সম্মান করা।
একজন নামাযীর মনে যাতে সার্বক্ষণিক আল্লাহর বিরাজমানতার ধারণা বহাল থাকে, সেইদিকে ঐ নামাযীকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন: “বান্দা নামাযের মধ্যে আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভ করে থাকে”।
উক্ত হাদিস দ্বারা জানা যায় যে নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যলাভ করে থাকে। তাই নামাযের সময় বান্দা এতটা নিকটে এসেও যদি বান্দার মনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য খেয়াল আসে, তবে এ নামাজ তার কোন কাজে আসবে না।
আমরা নামাযের জন্য প্রথমে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে জায়নামাযের দোয়া পড়ে থাকিঃ ‘ইন্না ওয়াজ্জাহ্তো ওয়াজহিয়া লিল্লাজী ফাতারাস্ সামাওয়াতে ওয়াল আরদা হানিফাঁও ওমা-মা-আনা মিনাল্ মুশ্রেকীন” (৬:৭৯)।
অর্থ “নিশ্চয় আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁরই দিকে মুখ ফিরালাম যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এবং আমি অংশীবাদিগণের অন্তর্ভুক্ত নই”- (৬নং সূরা আন্আম: ৭৯ নং আয়াত)।
আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ ‘ওয়াজহিয়া’ অর্থ মুখ বা মুখমণ্ডল বা চেহারা। উক্ত আয়াতে ‘মুখ’ বলতে শুধু বাহ্যিক মুখ নয় বরং অন্তরের মুখকেও বুঝানো হয়েছে। তাই নামাযে দাঁড়ালে বাহ্যিক মুখের সাথে মনের মুখও আল্লাহর দিকে ফিরাতে হবে। নামাযী ব্যক্তির অমনোযোগিতার জন্য আয়াতে ব্যবহৃত “মুখফিরালাম”- এই কথাটি যদি শুধু তার মুখের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, এর সঙ্গে তার অন্তরের কোন যোগ থাকে না, তাহলে নামাজের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্যলাভ হয় না। তখন নামাযী ও আল্লাহর মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়। নামাযরত অবস্থায় খেয়াল করা দরকার যাতে নামাযে মুখের কথার সাথে অন্তরের নিবিড় সংযোগ সাধিত হয়।
সাধারণতঃ নামাযে দাঁড়ালে অনেক নামাযীর মনে অসংখ্য চিন্তা ভিড় করে। এ চিন্তার ভিড়ে নামাযীর মন থেকে আল্লাহর উপস্থিতির ধারণা তলিয়ে যেতে পারে। শয়তানের চক্রান্তে নামাযীর মনে তার জীবনের নানা ঘটনা ফুটে উঠতে থাকে। নামাযের নিয়ত করার সাথে সাথে নামাযীর মুখের কথার সাথে তার অন্তরে বা মনের ধারণার মধ্যে অনৈক্য ঘটিয়ে শয়তান নামাযীর মন নিয়ে খেলতে থাকে। তখন নামাযীর দেহ ও মুখটি কেবলার দিকে থাকলেও মনের মুখটা থাকে দুনিয়ার ঘটনা প্রবাহের দিকে। এইভাবে শয়তান নামাযীর মনে আল্লাহর ইবাদতে অন্য চিন্তার সমাবেশ ঘটিয়ে তাকে নিজের অজান্তেগোনাহে জড়িত করে।
এমনিভাবে শয়তানের কারসাজিতে নামাযীর মুখের কথার সাথে মনের ভাবের গরমিল শুরু হয়। নামাযের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত কোন কোন নামাযীর মনে এ গরমিল পুরোমাত্রায় অব্যাহত থাকে। ফলে আল্লাহ ও নামাযীর মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিন্ন হয় এবং নামায হয়ে পড়ে সূরা মাউনের ৪; ৫, ৬ নং আয়াতের ন্যায়।
“ঐ সকল নামায আদায়কারীদের জন্য আক্ষেপ। যারা স্বীয় নামাযে অমনোযোগী। যারা শুধু লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করে (তাদের জন্যই আজাব)”- (১০৭ নং সূরা মাউন: আয়াত ৪,৫,৬)।
নামাযী ব্যক্তি প্রথমে নিয়ত করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাহারীমা বাঁধে। অতঃপর ‘সানা’ পাঠ করতে থাকে।
সানা-এর অর্থঃ “হে আল্লাহ! তুমিই পবিত্রতম, তুমিই প্রশংসনীয়, তোমার নামই বরকতপূর্ণ এবং তোমার সম্মানই সুউচ্চ; তুমি ব্যতীতত আর কোন উপাস্য নাই।”
সানার বাক্য মুখে উচ্চারণ করার সময় নামাযীর সামনে আল্লাহকে বিরাজমান ও প্রত্যক্ষদর্শী মনে করতে হবে। অন্যমনস্কভাবে শুধু মুখে এ ধরনের বাক্য উচ্চারণ করা নিরর্থক। এতে নামায হয়ে পড়ে প্রাণহীন, আল্লাহ বিবর্জিত ও লোক দেখানো প্রহসন।
সূরা ফাতেহা পাঠ করার সময় আমরা বলি- “নিশ্চয়ই আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং নিশ্চয়ই আমরা তোমারই সাহায্য কামনা করি। আমাদেরকে সোজা পথ দেখাও। তাদের পথ, যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রান্ত”। (সূরা ফাতেহাঃ ৪,৫,৬,৭ আয়াত)।
নামাযীর মুখের কথার সাথে মনের ঐক্য না থাকতে পারে। মুখে বলে, সে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে এবং একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য কামনা করে। অথচ মনে তার অন্যের চিন্তা এবং অন্যের সাহায্য পাওয়ার কামনা। মুখে বলে, “সোজা পথ দেখাও” কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সে বক্রপথের অনুসারী। মুখে বলে, আল্লাহর অনুগৃহীত বান্দাগণের পথে চলার কথা, অথচ কাজে-কর্মে অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথের অনুসারী।
অনেক নামাযী ব্যক্তি এভাবে মহান আল্লাহতালার প্রতি দারুণ অমনোযোগিতার মধ্যে দিয়ে সূরা পাঠ শেষ করে রুকুতে যায় এবং বলে- “সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম” অর্থঃ ‘আমার মহিমান্বিত প্রভু পবিত্রতম” অতপর রুকু হতে মাথা উঠানোর সময় বলে- “সামে আল্লাহু-লেমান হামেদাহ্” অর্থঃ “যে তাঁর প্রশংসা করে আল্লাহ তা শোনেন”। অথচ মনে হয়তো অন্যের খেয়াল। সম্মুখে আল্লাহর বিরাজমানতার ধারণা না থাকার জন্যই তার মনের এহেন বেখেয়াল অবস্থা।
নামায কায়েম করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- “আমাকে স্মরণ করার জন্য তোমরা নামায কায়েম কর”- (২০:১৪)। উক্ত আয়াত হতে বুঝা যায় যে, নামায পড়ার সময় একমাত্র আল্লাহর স্মরণ ছাড়া অন্য কোন কিছুর চিন্তা করা সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। ইবাদতের সময় মুখে যা বলা হয়, অন্তরে তা খেয়াল রাখা দরকার। মহান আল্লাহ আরও বলেন- “নিঃসন্দেহে নামায নির্লজ্জ ও মন্দকাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে”- (২৯:৪৫)।
আলোচ্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, নামায স্বকীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত এবং ধর্মের স্তম্ভ। তাই নামাযের মধ্যে একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়া নিহিত রয়েছে। যে ব্যক্তি নামায কায়েম করে, সে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তওফিক প্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামায পড়া সত্ত্বেও গোনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে না, বুঝতে হবে যে, তার নামাযের মধ্যেই কোন না কোন ত্রুটি বিদ্যমান রয়েছে এবং সে নামায কায়েম করার যথার্থ হক আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
রসুলুল্লাহ (সা.) যে রীতিনীতি পালন সহকারে নামায আদায় করেছেন, ঠিক সেভাবে নামায আদায় করতে হবে। যেমন শরীর পাক হওয়া, পরিধান বস্ত্র পাক হওয়া, নামাযের স্থান পবিত্র হওয়া, নিয়মিত জামাআতে নামায পড়া এবং নামাযের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সুন্নত অনুযায়ী সম্পাদন করা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মহান আল্লাহর সামনে এমনভাবে বিনয়াবনত ও একাগ্রতা সহকারে দাঁড়ানো যেন আল্লাহর সামনে আবেদন-নিবেদন করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ঐ ঈমানদারগণ নাজাত পেল যারা নামাযে বিনয়-নম্রভাব ধারণা করে”- (২৩ঃ ১-২ আয়াত)।
নামাযে বিনয়-নম্র হওয়ার অর্থ হচ্ছে, অনত্মর বা মন স্থির থাকা, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনাকে অন্তরে উপস্থিত না করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থির থাকা, অনর্থক নড়াচড়া না করা।
মোট কথা, নামায ছহীহ্-শুদ্ধ ও আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য করতে গেলে নামাযীর মনে ও সম্মুখে আল্লাহর বিরাজমানতার ধারণা অপরিহার্য। এই সংগে তকবীর, ক্বেরাত, রুকু, সেজদা, তসবীহ্ প্রভৃতি আদায় করার সময় মনোযোগ সহকারে ঐগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মনের স্থিরতার জন্য দাঁড়ান অবস্থায় সেজদারস্থানে, রুকুকালে পায়ের দিকে, সেজদার সময় নাকের দিকে, বসা অবস্থায় সিনার দিকে এবং সালামের সময় দুই কাঁধের দিকে নযর রাখতে হবে।
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধনসম্পদের দিকে চেয়ে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের মন ও আমল”- বোখারী।
দুনিয়া অথবা আখেরাতের কোন কাজ করতে গেলেই মনের প্রয়োজন অপরিহার্য। এবাদতে আল্লাহর বিরাজমানতা মনের উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এবাদতে আল্লাহ বিরাজমানতার ধারণা করতে গেলেই প্রথমে মন হাযির করা প্রয়োজন। মন স্থির করতে পারলেই আল্লাহর বিদ্যমানতা ধারণা করা সহজ। তাই মানুষের মন স্থির করে এবাদত করা অবশ্য কর্তব্য।
তথ্য সুত্র
d.azadi
Post a Comment