কুরবানী শব্দটি আরবী কুরবান শব্দ থেকে গঠিত। আর কুরবান শব্দটি কুরবাতুন শব্দ থেকে উৎপন্ন। আরবী কুরবাতুন এবং কুরবান উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্যলাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় কুরবান ঐ বস্তুর নাম যা দ্বারা আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভ করা যায়। তফসীরে কাশশাফ ১ম খণ্ড ৩৩৩ পৃষ্ঠা, বায়যাভী ১ম খন্ড ২২২ পৃষ্ঠা)
বর্তমানে আমাদের নিকটে কুরবানীর পশুকেই বিশেষভাবে কুরবান বলা হয়। (তফসীরে আলমানার ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩৪২ পৃষ্ঠা। পরিশেষে ঐ যবেহকৃত জন্তুকেই কুরবান বলা হয় যা লোকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পেশ করতে থাকে। (তফসীরে মাযহারী ২য় খন্ড ১৮৮ পৃষ্ঠা)
ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ উপমাহদেশে কুরবানী বলতে বোঝায় যিলহজ্জ মাসের ১০ম থেকে ১২ই বা ১৩ই তারিখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উট, গরু, বকরী ও ভেড়া প্রভৃতির মধ্য হতে কোন এক জন্তুকে নহর বা যবাহ করা।
আরবীতে কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। তাই কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি মোট তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ১. সুরা আ-লে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াতে। ২, সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াতে এবং ৩. সুরা আহকা-ফের ২৮নং আয়াতে। হাদীসেও কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে তার পরিবর্তে উযহিয়্যাহ এবং যাহিয়্যাহ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এইজন্য কুরবানীর ঈদকে ঈদুল আজহা বলা হয়। ফরাসী, হিন্দি ও উর্দুতে আরবী কুরবান শব্দটি কুরবানী অর্থে ব্যবহৃত হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে কুরবানী কবে থেকে চালু হয়েছে সে ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি যাতে তারা পালিত চতুষ্পদ জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে যা তিনি তাদেরকে রিজিক হিসেবে দান করেছেন (সুরা হজ্জ ৩৪ আয়াত) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, (হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহতাআলা তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। তাফসীরে কাশশাফ ২য় খন্ড ৩৩ পৃষ্ঠা)
কুরআনের ৬ষ্ঠ পারায় সূরা মায়িদার ৮ম রুকুতে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর বর্ণনা আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই প্রথম কুরবানী। তফসীরের বর্ণনায় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইঃ মুফাসসিরে কুরআন হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হযরত হাওয়া আলায়হাস সালামের গর্ভে জোড়া জোড়া সন্তান পয়দা হতো, কেবল হযরত শীস (আঃ) ছাড়া। কারণ, তিনি একা ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। সেই সময় হযরত আদম (আঃ) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। কারণ, তখন যে জোড়ার সাথে যে মেয়ে জন্মাতো সেই জোড়ার ছেলের সাথে ঐ জোড়ার মেয়ের বিয়ে হালাল ছিল না। অতঃপর হযরত হাওয়া (আঃ) কাবীলের সাথে একটি সুন্দরী মেয়েকে জন্ম দেন যার নাম আকলীমা এবং হাবীলের সাথে এমন একটি মেয়ে জন্ম দেন যে আকলীমার মত ছিল না। ঐ মেয়েটির নাম লিয়ূযা। অতঃপর হযরত আদম (আঃ) যখন উক্ত দুই জোড়ার বিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তখন কাবীল বলে, আমি আমার জুড়ি বোনের হকদার বেশি। তথাপি হযরত আদম (আ.) তাকে তাঁর নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানলো না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিলনা। অতঃপর তাঁরা সবাই কুরবানী দেবার ব্যাপারে একমত হলেন।
তাঁদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লামা আবু আলী আলফারসী বলেন, কাবীল ছিলেন চাষী। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভাল মালগুলো বের করে নিয়ে বাজে মালগুলোর একটি আঁটি কুরবানীর জন্য পেশ করেন। আর হাবীল ছিলেন পশুপালনকারী। তাই তিনি তাঁর জন্তুর মধ্য থেকে সবচেয়ে সেরা একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করেন। অতঃপর হাবীলের জন্তুটি আসমানে তুলে নেয়া হয় যা সেখানে চরতে থাকে! পরিশেষে ঐ দুম্বাটি দিয়ে হযরত ইসমায়ীল আলায়হিস সালামকে বাঁচিয়ে নেয়া হয়। পূর্ববর্তী আলেমদের একটি দল একথা বলেন। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, আসমান থেকে আগুন অবতীর্ণ হয় এবং হাবীলের কুরবানীটি জ্বালিয়ে দেয়। (তফসীর ইবনে কাসীর, দুররে মনসুর, ফতহুল বায়ান, ৩য় খন্ড ৪৫ পৃষ্ঠা ও ফতহুল কাদীর ২য় খণ্ড ২৮ ও ২৯ পৃষ্ঠা)
হযরত আদম আলায়হিস সালামের যুগে তাঁরই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। সূরা হজ্জের ৩৪নং আয়াতটি তার প্রতি ইঙ্গিত করে। তবে ঐসব কুরবানীর কোন বর্ণনা কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তাই ঐসব কুরবানীর বিবরণ এখানে দেয়া গেল না। বর্তমানে উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে যে কুরবানী চালু আছে তার সম্পর্ক হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের নিজপুত্র ইসমাইলকে কুরবানী করার সাথে সংশ্লিষ্ট।
জনবিরল মক্কা নগরীর এক বিজন প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দাহ হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল আলায়হিমাস সালাম কুরবানীর যে মহান আদর্শ পেশ করেছিলেন সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি নিয়ে প্রতি বছর আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ঈদুল আজহা বা কুরবানীর ঈদ। এই কুরবানী সম্পর্কে একদা মহানবী (সাল্লাল্লা-হু আলাইহি অসাল্লাম) কে তাঁর কতিপয় সাহাবায়ে ই-কেরাম জিজ্ঞেস করলেন-
(ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) মা-হা যিহিল আযা-হী) অর্থাৎ হে আল্লাহর রসূল (সা.)! এই কুরবানী কি জিনিস? তিনি বললেন:
(সুন্নাতু আবীকুম ইব্রাহীম আলায়হিস সালা-ম) এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর আদর্শ। এবার তাঁরা বললেন, এতে আমাদের লাভ কি? তিনি বললেনঃ কুরবানীর পশুর প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তোমরা একটি করে নেকী পাবে (মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকী, ইবনে মা-জাহ, মেশকাত)।
বিশ্বনবীর উল্লেখিত হাদীসটিকে যারা বিশ্বাস করেন এবং যারা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে একটু চিন্তা-গবেষণা করেন তাদের মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, ইব্রাহীম (আঃ) এর মধ্যে এমন কি গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল যার ফলে বিশ্বনিয়ন্তা তাঁর এই আদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রাখলেন? এবং উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ঐ আদর্শকে আনন্দ ও খুশির উৎসে পরিণত করলেন? দুনিয়ার বড় বড় রাজা মহারাজা, বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্ব, জলে ও স্থলে শাসন পরিচালনাকারী মহান জাতিসমূহকে আমরা প্রাচীন নিদর্শনসমূহের ভগ্নাবশেষে, পচাসড়া করবসমূহের মধ্যে, জাতীয় ঐতিহ্য ও ইহিসাসের পুরাতন পাতাগুলোতে দেখতে পারি। কিন্তু পূর্ববর্তী যুগের সমস্ত জনসমাগমের মধ্যে এমন একটিও ব্যক্তিত্ব পাওয়া যাবে না যার জীবনাদর্শ বইয়ের পাতায় ও মাটির স্তূপে নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের মনিকোঠায় ও তাদের বাস্তব কাজে স্বীয় প্রাণবন্ততার প্রমাণ দিতে পারে। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য আপনি কল্পনার বাহনে চড়ে মক্কায় চলে যান দেখবেন লক্ষ লক্ষ ইব্রাহীম এখনও সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং ইব্রাহীমের আদর্শে আদর্শবান হবার জন্য বিশ্ববাসীকে বিপ্লব সৃষ্টিকারী আহ্বান জানাচ্ছে?। তাই সবারই জানতে কৌতূহল হয় যে, ইব্রাহীম কে এবং তাঁর আদর্শ কি? তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হল।
পারস্য উপসাগর হতে আনুমানিক ১০০ মাইল দূরে বহু বিপ্লবের সাক্ষী দুটি ঐতিহাসিক নদী দজলা ও ফোরাত। এই দুই নদীর তীরবর্তী নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলের একটি দেশ, যার প্রাক্তন নাম ব্যাবিলন এবং বর্তমান নাম ইরাক। ঐ ব্যাবিলনের একটি জনপদের নাম ছিল উর। সেখানে জন্মগ্রহণ করেন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। যারা দুনিয়ার খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, পৃথিবীর প্রাক্তন সপ্তম আশ্চর্য বস্তুর মধ্যে একটি আশ্চর্য বস্তু ছিল ব্যাবিলনের ‘শূন্য উদ্যান’। এই শূন্য উদ্যানের যারা আবিষ্কারক তারা ছিলেন যে যুগে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য ও শিক্ষিত জাতি কালদানি জাতি বা চ্যালিডিস জাতি। ঐ জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হলেও তারা সবাই চাঁদ, সূর্য, তারকা ও প্রতিমার পূজারী মুশরিক ছিল। উক্ত মুশরিকদেরই এক পুরোহিত ছিলেন আযর। এই অংশীদারী আযরের ঘরে জন্মেছিলেন তওহীদবাদী ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। বহুত্ববাদিতা ও নাস্তিকতার জঘন্য পরিবেশে প্রতিপালিত হয়ে যখন ইব্রাহীমের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল তখন তিনি দেখতে পেলেন কোথাও সে যুগের সভ্যজাতি সূর্যকে পূজা করছে। কোথাও তারা চাঁদকে পূজা দিচ্ছে। কোথাও তারকাকে ইষ্ট ও অনিষ্ট দেবতা মনে করছে। আবার কোথাও নিজহাতে গড়া প্রতিমার সামনে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ অসহায়ের মত মাথা নত করছে। এই অভিনব দৃশ্যাবলী দেখে তিনি তাদেরকে নানারকম যুক্তি-তর্ক ও কলা-কৌশল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা তার কথায় কান না দিয়ে তাকেই আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করলেন। মহিমাময়ের কল্পনাতীত মহিমায় তিনি উদ্ধার পেলেন।
অতঃপর তিনি যখন উপলব্ধি করলেন যে, তার জন্মদাতা পিতা ও তার আত্মীয় স্বজনসহ সমস্ত দেশবাসী তার তওহীদ বাণী কবুল করতে কোনমতেই রাজী নয় তখন তিনি স্বীয় ঘর বাড়ী, ধন সম্পত্তি, মাতৃভূমি ও স্বজাতি এবং সবরকম সম্পর্ককে আল্লাহর রাহে কুরবানী দিয়ে স্বীয় মতাবলম্বী সহধর্মিনী বিবি সা-রাহ ও তাঁর মতানুসারী ভাইপো লুত (আঃ) কে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ার দিকে হিজরত করলেন এবং দেশবাসীকে বললেনঃ আমি নিঃসন্দেহে তোমাদের মায়া ত্যাগ কোরে আমার রবের দিকে যাচ্ছি। অচিরেই তিনি আমাকে পথ বাতলে দেবেন। (সূরা সা-ফফা-ত ৯৯ আয়াত) কেউ কেউ বলেন, এই হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৭৫ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে ইব্রাহীমই প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাহে হিজরত করেন ও স্বীয় মাতৃভূমি ত্যাগ করেন। (ফাতহুল বয়ান ৭ম খন্ড ১৫৩ পৃষ্ঠা) সারা পৃথিবী যখন শিরক ও কুফরে আচ্ছন্ন ঠিক সেই সময় সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন আল্লাহ প্রেমিক তিন ব্যক্তির এই কাফেলা কতই না বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। আজকের এই উন্নত যুগে তার কল্পনাও করা যায় না। পথিমধ্যে তাঁর জীবনসঙ্গিনী বিবি সা-রার উপর পাশবিক হামলার চেষ্টা হল। কিন্তু করুণাময়ের অদৃশ্য লীলায় মুসীবতের সেই কালো মেঘ কোনরূপে কেটে গেল। সেই সঙ্গে ঐ মুসীবতের প্রতিফল স্বরূপ তিনি একটি তুহফা বিবি হাজেরাকে উপহার পেলেন। পরে যাকে তিনি স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেন। এভাবে বিপদের পর বিপদের মধ্যে তাঁর জীবনের আশিটি বছর কেটে গেল, কিন্তু তাঁর তওহীদী মিশন ব্যর্থ হয়ে থাকলো। মানুষের জীবনের এটাই সেই সময় যখন বার্ধক্যের লাঠিস্বরূপ কোন এক আশ্রয়ের কথা বেশী কোরে চিন্তা করে। এতদিন পর্যন্ত ইব্রাহীমের ঘরেও কোন সন্তান পয়দা হয়নি। তাই তিনি ভাবতে লাগলেন, তাইতো এ যুগের অভাগা বিশ্ব আমার তওহীদী মিশন চালাতে রাজী নয়। অতএব এ সময় যদি আমার কোন উত্তরাধিকারী থাকতো তাহলে আমার পরে সে আমার মিশনকে চালু রাখতো। এরূপ অনেক কথা চিন্তা ভাবনা করে তিনি স্বীয় প্রভুর দরবারে হাত তুললেন এবং অনুনয় ও বিনয় সহকারে বললেন: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুসন্তান দান কর (সুরা সা-ফফা-৩ ১০০ আয়াত)।
কথায় বলে অন্তর থেকে যেকথা বের হয় তদ্বারা কাজ নিশ্চয়ই হয়। তাই ব্যথিতের ফরিয়াদ গ্রহণকারী আল্লাহ বলেন-
অতঃপর আমিও তাকে (ইব্রাহীমকে) একটি ধৈর্যশীল ছেলে দান করার সুসংবাদ শুনিয়ে দিলাম (সূরা সাফফাত ১০১ আয়াত)। বিখ্যাত মুফাসসির মুকাতিল বলেন, যখন হযরত ইব্রাহীম বায়তুল মুকাদ্দাসে আসেন তখন এই দুআ করেন এবং মুফাসসিরে কুরআন ইবনে আব্বাস বলেন, যখন তিনি সিরিয়ায় হিজরত করেন তখন এই প্রার্থনা করেন। ফাতহুল বায়ান, ৮ম খন্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা)
অতঃপর ইব্রাহীমের ঘরে একটি ছেলে পয়দা হল। ছেলেটির ব্যাপারে ইব্রাহীম (আঃ) যখন স্বীয় রবের কাছে দুআ করেছিলেন তখন তিনি তাঁর প্রভুকে বারবার বলেছিলেনঃ ‘ইসমাঅ্ ইয়া-য়ীল ইসমাঅ্ ইয়া-য়ীল।’ হে আল্লাহ! আমার ফরিয়াদ শোন, আল্লাহ গো! আমার দুআ কবুল কর)। তাই ছেলেটির নাম রাখা হল ইসমায়ীল। (ফাতহুল বায়ান, ১ম খন্ড, ১৮০ পৃষ্ঠা)। সে সময় ইব্রাহীমের বয়স ছিল ৮৬। (ইবনে কাসীর, ৪র্থ খন্ড, ১৫ পৃষ্ঠা)। ছেলের মুখ দেখলে কে-না খুশী হয় এবং বুড়ো বয়সে লাঠির সাহায্য কে- না চায়। তাই বুড়ো বয়সে লাঠি-স্বরূপ পুত্র পেয়ে ইব্রাহীমের মনে খুশীর বান ডাকলো।
অন্য দিকে লীলাময়ের তরফ থেকে আবার পরীক্ষার ধারা শুরু হল। তাই ইব্রাহীমকে হুকুম হল, তুমি তোমার স্ত্রী হাজেরা এবং তোমার নয়নের তারা ইসমায়ীলকে মক্কার ঘাস ও পানিহীন মরুভূমিতে রেখে এসো। যে ইব্রাহীম স্বীয় জানমাল এবং স্বীয় মাতৃভূমি ও স্বজাতিকে ত্যাগ করে এসেছেন তিনি এই হুকুম মানতে কি দ্বিধাবোধ করতে পারেন? তাই তিনি জনমানবহীন মক্কা শহরে হাজেরা ও ইসমায়ীলকে রেখে এলেন।
অতঃপর কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ছেলেটি যখন দৌঁড় ঝাপ করতে শিখলো এবং মুফাসসিরে কুরআন ফারবার মতানুয়ায়ী ছেলেটি যখন ১৩ বছর বয়সে পা দিল তখন হযরত ইব্রাহীমকে স্বপ্নে হুকুম দেওয়া হল যে, তুমি তোমার কলিজার টুকরা ইসমায়ীলকে আল্লাহর রাহে কুরবানী কর। মুকাতিল বলেন, এই স্বপ্ন তিনি উঠোউঠি তিন রাতেই দেখলেন। (ফতহুল বায়ান, ৮ম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা।)
যিলহজ্জের ৮ম রাতে তিন সর্বপ্রথম স্বপ্ন দেখেন যে, একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে যব্হ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর ঐদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এই চিন্তায় বিভোর থাকেন যে, এটা আল্লাহর তরফ থেকে সুস্বপ্ন, না দুঃস্বপ্ন। অতঃপর ৯ম রাতে তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। ফলে ঐ দিন তিনি জানতে ও বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহ্র তরফ থেকে সত্যিকার স্বপ্ন। তারপর ১০ম রাতে তিনি আবার ঐ স্বপ্ন দেখেন। তাই ঐ দিনে তিনি কুরবানী করতে উদ্যত হন। পরপর তিনরাত স্বপ্ন দেখার পর তাঁর মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত তিনটি দিন বিশেষ নামে বিশেষিত হয়েছে। যেমন যিলহজ্জের ৮ম দিনের নাম ‘ইয়াওমুত তারভিয়াহ’ বা চিন্তাভাবনার দিন। ৯ম দিনের নাম ‘ইয়াওমুল আরাফাহ’ বা জানার দিন। ১০ম দিনের নাম ‘ইয়াওমুন নাহর বা কুরবানীর দিন। (তফসীরে কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৪৯ পৃষ্ঠা, তফসীরে বাগাভী ও খাযিন ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৩ পৃষ্ঠা রহুল মাআ-নী, ২৩ খণড, ১২৮ পৃষ্ঠা)
কুরবানীর ব্যাপারে ইব্রাহীমের কাছে সরাসরি অহী না এসে তাকে স্বপ্ন দেখান হল কেন? এ ব্যাপারে তত্ত্বদর্শীগণ বলেন, আল্লাহতাআলা যখন জিব্রাইলকে এই হুকুম দেন যে, ইব্রাহীমকে তুমি এই পয়গাম পৌঁছে দাও যে, সে যেন তাঁর নয়নমনি ইসমায়ীলকে আল্লাহর রাহে কুরবানী করে তখন জিব্রীল আমীন আল্লাহকে বলেন হে পরওয়ারদেগার! ইব্রাহীমকে আমি সব সময়ে খুশী ও মঙ্গলের সুসংবাদ দিয়ে এসেছি। অতএব তাঁর বৃদ্ধ বয়সের ঐ ছেলেটাকে কুরবানী করার কথা আমি কি করে তাকে বলি? ফলে আল্লাহতাআলা নাকি ঐ অহীটিকে স্বপ্নে রূপান্তরিত করে দেন। ইবনে আবী হাতেম বিওয়ায়াত করেছেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ঘুমন্ত অবস্থায়ও নবীদের স্বপ্ন অহী। (ইবেন কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা)।
এই স্বপ্ন দেখার পর ইব্রাহীম (আ:) পুত্রকে কুরবানী করার জন্য তৈরী হলেন এবং স্বীয় বিবি হাজেরাকে বললেন, ছেলেটাকে মুখহাত ধুইয়ে কাপড় পরিয়ে দাও। ওকে একটা কাজে নিয়ে যাব। মুসান্নাফ আবদুর রাযযাকে কা’ব আহবার থেকে একটি রিওয়ায়াত রয়েছে যে, যখন ইব্রাহীমকে কুরবানীর স্বপ্ন দেখানো হয় তখন শয়তান মনে মনে বলে যে, এই সময় যদি আমি তাদেরকে ফেতনায় না ফেলতে পারি তাহলে আর কখনো পারবো না। অত:পর দুই বাপবেটা যখন ঘর থেকে বের হলেন তখন শয়তান বিবি হাজেরার নিকটে গিয়ে হাজির হল এবং তাঁকে বললো: তোমার বেটাকে ইব্রাহীম কোথায় নিয়ে গেলেন: তিনি বললেন: কোন কাজে নিয়ে গেছেন। এবার শয়তান বলল, না-না। তিনি তাকে কোন দরকারে নিয়ে যাননি বরং তাকে যবেহ করতে নিয়ে গেছেন। হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন, তিনি তাকে যবেহ করবেন কেন? শয়তান বললো- ইব্রাহীমের ধারণা যে, তাঁর রব নাকি তাঁকে এই কাজের হুকুম দিয়েছেন। একথা শুনে হাজেরা বললেন: তাহলে তো তিনি তাঁর পরওয়ারদেগারের হুকুম তামীল করে খুব ভাল কাজ করেছেন।
এখানে শয়তান নিরাশ হয়ে তাদের দু’জনের পেছনে ছুটলো। অত:পর ছেলেটিকে গিয়ে বললো: তোমার বাপ তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছেলেটি বললো, কোন কাজে হবে। শয়তান বললো, না, কোন কাজে নয়, বরং তোমাকে যবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছেন। সে বললো, আমাকে তিনি যবেহ করবেন কেন? শয়তান বললো, তাঁর ধারণা যে, তাঁর প্রভু নাকি তাঁকে এই নির্দেশ দিয়েছেন। ছেলেটি বললো- আল্লাহ্র কসম! যদি তাঁকে আল্লাহ্তাআলা এ কাজের হুকুম দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয় নিশ্চয় এই কাজ করবেন। এখানে শয়তান সুবিধা করতে পারলো না।
তাই এবার সে ইব্রাহীমের কাছে গিয়ে ভিড়লো এবং তাঁকে বললো, আপনার ছেলেকে সকালে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, একটি দরকারে। শয়তান বললো, আপনি তো ওকে কোন প্রয়োজনে নিয়ে যাচ্ছেন না, বরং যবেহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, আমি একে যবেহ করব কেন? শয়তান বললো, আপনি মনে করেন যে, আপনার রব নাকি আপনাকে এই কাজের নির্দেশ দিয়েছেন! তিনি বললেন: আল্লাহ্র কসম! যদি তিনি আমাকে এই কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আমি একাজ অবশ্য অবশ্যই করবো। (ইবনে জরীর ও ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা।)
কতিপয় ঐতিহাসিক ও তফসীরী বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, শয়তান তিনবার হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবারেই তিনি ৭টি করে কাঁকর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। তাঁর ঐ কাঁকর মারার স্মৃতি আজও প্রতি বছর হজ্বের সময় পালন করা হয়। (তফসীরে বাগাভী ও খাযিন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৪ পৃষ্ঠা, এবং তাফসীরে মাযহারী, ৮ম খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা।) শয়তানকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর ইব্রাহীম তাঁর ছেলেকে বললেন:- প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি যব্হে করছি। অতএব এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ছেলেটি বললো: বাবা! আপনি তাই করুন আপানকে যা হুকুম দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন (সূরা সা-ফফা-ত ১০২ আয়াত)।
এভাবে বাপ বেটার সওয়াল জওয়াবের পর ছেলেটি যখন রাজি হয়ে গেল তখন দু’জনই আল্লাহর কাছে নিজেদের সঁপে দিল। কাতাদাহ বলেন: ছেলেটি জানদেনেওয়ালার সামনে তার জানের তুহফা পেশ করল এবং তাঁর বাপ নিজ কলিজার টুকরা ছিঁড়ে আল্লাহ্র সামনে রেখে দিল। (তফসীরে কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৫৩ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান, ৮ম খণ্ড, ৭১ পৃষ্ঠা।)
ইবনুল মুনযির ও মুস্তাদরকে হাকিমে মুজাহিদ থেকে বর্ণনা রয়েছে যে, তারপর ছেলেটি তার বাপকে বললো: আপনি আমাকে চোখে দেখা অবস্থায় যব্হে করতে পারবেন না। কারণ, আপনার হয়তো ছেলের মায়া উথলে উঠতে পারে। ফলে আপনার ছুরি নাও চলতে পারে? কিংবা আমি হয়তো অধৈর্য হোয়ে ছটফট করতে পারি এবং আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিতে পারি? সেজন্য আপনি আমার হাত থেকে ঘাড় পর্যন্ত কষে বেঁধে দিন। তারপর আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন। (শেষোক্ত, ৭৩ পৃষ্ঠা।)
অন্য বর্ণনায় আছে, ছেলেটি আবার বললো, বাবা! আপনি নিজের কাপড়টা সাপটে দিন এবং আমাকে ভাল করে বেঁধে দিন। যাতে আমার রক্তের ছিটে আপনার গায় না লাগে এবং আমার নেকি কমে না যায়। আর যব্হের পর আপনি যখন আমার মায়ের কাছে যাবেন তখন তাঁকে আমার সালাম দেবেন। আর আপনি যদি আমার জামাটা মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চান তাহলে নিয়ে যাবেন। যাতে তিনি কিছুটা সান্ত¡না পাবেন। কলিজার টুকরা একমাত্র কচি বাচ্চার মুখ দিয়ে এরূপ কতো শুনে হযরত ইব্রাহীমের মনে কি প্রতিক্রিয়াই না হতে পারে! তথাপি তিনি ধৈর্য্যরে অটল পাহাড় হয়ে জওয়াব দিচ্ছেন, বাবা! তুমি আল্লাহ্র হুকুম পালনার্থে আমার কি উত্তম সাহায্যকারী! কথাটি বলে তিনি পুত্রকে চুমু খেলেন এবং ছলছল চোখে তাকে বাঁধলেন। (তফসীরে বাগাভী ও খাযেন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা এবং কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা।) অত:পর কুরআনের ভাষায়-
ইব্রাহীম তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। মুসনাদে আহমাদে একটি হাদীস রয়েছে যে, তখন ইসমাইলের গায়ে একটি সাদা জামা ছিল। তাই সে বললো যে আব্বাজান! এটা ছাড়া আমার কাছে আর তো কোন কাপড় নেই যদ্বারা আপনি আমাকে কাফন দিতে পারেন। অতএব আপনি এই জামাটি খুলে নিন যাতে আমার কাফনের কাজ হয়ে যায়! সুতরাং তিনি জামাটা খুলে নিলেন। (ইবনে কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা।)
এবার শুরু হল আসল লীলাখেলা। অর্থাৎ ছেলেটির গলায় ছুরি চালাবার পালা। ইলাহী হুকুমের কাছে আত্মসমর্পনের মুর্ত প্রতীক ইব্রাহীমের হাত যখন ছেলেটির গলায় ছুরি চালিয়ে দিল ত্রিভুবন তখন কেঁপে উঠলো। সে কি অভিনব দৃশ্য! পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে ঘটবে কি না তাও কে বলতে পারে। একদিকে জনমানবহীন, পশুপক্ষী ও প্রাণীহীন মক্কা শহর। অন্যদিকে ধু ধু বালির মধ্যে খাঁ খাঁ করছে মিনার ঐতিহাসিক প্রান্তর। আর তারই মাঝে একটি ৯৯ বছরের বৃদ্ধ বাপ এবং তাঁর ছুরির তলায় পড়ে রয়েছে ১৩ বছরের ফুল্ল কুসুমিত এক তরুণ কিশোর। এই অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে আকাশ যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে এবং আদমের জন্মের সময় প্রবল আপত্তিকারী ফেরেশ্তারাও যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। গাছপালা কেউ আর নড়ছে না এবং পশু-পক্ষীরাও যেন চলাফেরা করতে পারছে না। বাতাসের গতিও যেন স্তব্ধ হয়ে গেল এবং পাহাড় ও পর্বতেও যেন একটা নিঝুমভাব ফুটে উঠলো। সবাই যখন বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে এই অভাবনীয় কাণ্ড দেখছে ইব্রাহীমের হাত তখন ইসমাইলের গলায় অনবরত চলছে। কিন্তু দয়াময়ের লীলা বুঝা বড় ভার! তাই ইমাম সুদ্দী বলেন: এদিকে আল্লাহ ইব্রাহীমকে হুকুম দিয়েছেন নিজহাতে ছেলে যব্হ কর, আর ওদিকে তিনি ছুরিকে নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি মোটেই কেটেনা। ফলে ছুরি এবং তার গালার মাঝখানে আল্লাহ্র কুদরতে একটি পিতলের পাত আড় সৃষ্টি করে। সেজন্য ইব্রাহীম বারবার ছুরি চালালেও কোন কাজ হচ্ছিল না। (ঐ ১৭ পৃষ্ঠা ও ফাতহুল বায়ান, ৮ম খণ্ড, ৭২ পৃষ্ঠা।)
এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতিতে ত্রিভুবনের সবাই যখন হতভম্ব এবং হতবাক ও শ্বাসরুদ্ধ তখন লীলাময় আল্লাহ তাঁর লীলার রহস্য ফাঁস করে দিয়ে জান্নাত থেকে জিব্রাইলের মাধ্যমে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসমাইলকে বাঁচিয়ে নিয়ে ইব্রাহীমের অজান্তে সেই দুম্বাটিকে তার দ্বারা যবেহ করিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন-
হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়েছো। আমি এভাবে (পরীক্ষার মাধ্যমে) নেক ও সৎলোকদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নি:সন্দেহে এটাও একটা বিরাট পরীক্ষা। তাই আমি এক বিরাট কুরবানীর বদলে তাকে (অর্থাৎ তোমার ছেলে ইসমাইলকে) বাঁচিয়ে নিয়েছি (সূরা সা-ফ্ফা-ত ১০৪-৭ আয়াত)। ইবনে আব্বাসসহ অধিকাংশ মুফাসসিরীনের মতে ইব্রাহীমের নিকট সেই দুম্বাটি পাঠানো হয়েছিল যেটাকে জান্নাতে চল্লিশ বছর ধরে লালন-পালন করা হয়েছিল। (ফা.বা. ৭৩ পৃষ্ঠা) কিন্তু ইবনে আবী হাতেম ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এটা সেই দুম্বা যেটা আদম (আ:)-এর ছেলে (হাবীল) আল্লাহর দরবারে কুরবানী করেছিল এবং সেটা কবুলও হয়েছিল। তখন থেকে ওটা জান্নাতে চরতে থাকে। পরিশেষে ওর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ইসমাইলকে বাঁচিয়ে নেন। (ইবনে কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, ১৭ পৃষ্ঠা, কাবীর, ৭ম খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা)।
একটি বর্ণনায় আছে, ইব্রাহীম যখন ইসমাইলকে যবেহ করছিলেন তখন জিব্রাইল বলেছিলেন- আল্লাহু আকবার০ আল্লাহু আকবার০ এবং ইসমাইল বলেছিলেন- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ০ আল্লা-হু আকবার। অত:পর ইব্রাহীম বলেন, আল্লা-হু আকবার০ অলিল্লা-হিল হামদ।
তারপর থেকে এই তকবীরটা চিরস্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়। (তফসীরে নাসাফী, ৪র্থ খণ্ড, ২০ পৃষ্ঠা, কাশশাফ, ৩য় খণ্ড, ৩০৮ পৃষ্ঠা, ৫৪৮ পৃষ্ঠা, ফাতহুল বায়ান, ৮ম খণ্ড ৭৪ পৃষ্ঠা)।
জন্মদিন থেকে জীবনের ৯৯টি বছর ধরে একটার পর একটা পরীক্ষা করে যখন পরওয়ারদেগারে আলম ইব্রাহীমের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন তখন তার এই চিত্তহারী, রোমাঞ্চকর ও বিপ্লব সৃষ্টিকারী কীর্তিকে কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষয় করে দিলেন এই বলে-
আমি তোমার এই সুমহান আদর্শকে পরবর্তীদের জন্য চির স্মরণীয় করে রাখলাম। তোমার এইসব কীর্তির দরুন তোমার প্রতি আমার রহমত ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক (সূরা সা-ফফা-ত ১০৮ আয়াত)।
অত:পর আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক তখন থেকে চলে আসছে এই ইব্রাহীমী আদর্শের বাস্তবায়ন। তাই আজো লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর হুকুম তামীলের সাথে সাথে প্রতি বছর ইব্রাহীমের স্মৃতি পালন করে পাপমোচন-সাগরে করছে অবগাহন। আল্লাহর বাণী প্রচারার্থে ৭৫ বছরের মায়ামমতা বিজড়িত মাতৃভূমি ত্যাগকারী, মানবজাতির ইতিহাসে পৃথিবীর সর্বপ্রথম হিজরতকারী হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর বাস্তুভিটা ত্যাগের আদর্শ, যুক্তি ও তর্ক সহকারে তওহীদের (একত্ববাদের) উদাত্ত ধ্বনি বলিষ্ঠকণ্ঠে ও নির্ভীকচিত্তে প্রচার করার খাতিরে শিরকের (বহুত্ববাদিতার) মূর্ত প্রতীক জন্মদাতা পিতার অপত্যস্নেহ ও স্বদেশবাসীর অকৃত্রিম ভালবাসার মায়াজাল ছিন্নকারী, অসহায় ও দৃঢ়চিত্ত ইব্রাহীমের প্রেরণাদায়ক আদর্শ, ইচ্ছাময়ের ইচ্ছার কাছে নিজের কামনা ও বাসনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বীয় কলিজার টুকরাকে নিজ হাতে কুরবানীর জন্য ছুরি চালানেওয়ালা ইব্রাহীমের অনুপম আদর্শাবলী অনাগত বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয়, বরণীয় ও চিরস্মরণীয় হবার যোগ্য নয় কি? এগুলোই হল ইব্রাহীমের সেই সব বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যার কারণে বিশ্বনিয়ন্তা ইব্রাহীমের আদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত করে দিয়েছেন চিরস্থায়ী। সেজন্য ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পাঁচ হাজার বছর থেকে হয়ে রয়েছেন কালজয়ী এবং বিশ্বের তওহীদ বাদীদের মনবিজয়ী।
গ্রন্থনা:
ম মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
০ অধ্যাপক মাওলানা আইনুল বারী ০
Post a Comment