السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

ইসলামী অনুশাসন ও পরিবার - জাফর আহমাদ

| comments

আপনি যদি ইসলামের একজন পূর্ণাঙ্গ ও নিবেদিত অনুসারী হন, তাহলে সর্বপ্রথম আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য দাঁড়ায় আল কুরআনের প্রসিদ্ধ সেই আয়াতটির বাস্তবায়ন করা যাতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে লোকেরা যারা ঈমান এনেছো, তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্তুতিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো মানুষ ও পাথর হবে যার জ্বালানি। সেখানে রূঢ় স্বভাব ও কঠোর হৃদয়ের ফেরেশতা নিয়োজিত থাকবে যারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।” (সুরা তাহরীম: ৬) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একজন তাফসীরকারক বলেছেন, আল্লাহর আযাব থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর মধ্যেই কোন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রকৃতির বিধান যে পরিবারটির নেতৃত্বের বোঝা তার কাঁধে স্থাপন করেছে তার সদস্যরা যাতে আল্লাহর প্রিয় মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারে সাধ্যমত সে শিক্ষা দীক্ষা দেয়াও তার কাজ। তারা যদি জাহান্নামের পথে চলতে থাকে তাহলে যতটা সম্ভব তাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তার সন্তান শুধুমাত্র পৃথিবীতে সুখে থাকুক এ চিন্তা হওয়া উচিত নয়। বরং তার চেয়েও বড় চিন্তা হওয়া উচিত এই যে, তারা যেন আখেরাতে জাহান্নামের ইন্ধন না হয়। বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসুলুল্লাহ স: বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই রাখাল এবং তাকে তার অধীনস্থ লোকদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। শাসকও রাখাল, তাকে তার অধীনস্থ লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।


আমরা আমাদের সন্তানদের প্রচুর্যের মধ্যে রেখে যাওয়াকে এতটাই গুরুত্ব দিয়ে থাকি যে, আমাদের সকল চিন্তা-চেতনা সেদিকেই কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্তু ছেলে-মেয়ে আখিরাতে প্রাচুর্যের অধিকারী হোক সে কথাটি আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অবশ্য ইসলাম সন্তানদের প্রাচুর্যের মধ্যে রেখে যাওয়াকে উপেক্ষা করে না। বরং উল্টো দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে যাওয়াকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “বল, দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকর এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানকারী দ্রব্যাদি ও পবিত্র-উৎকৃষ্ট খাদ্য-পানীয় তো আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাহদের কল্যাণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন; সেসবকে হারাম ও নিষিদ্ধ করে দিতে পারে কে? (সুরা আরাফ: ৩২) অর্থাৎ এই পৃথিবীতে জাঁকজমক, স্বাদ, আস্বাদন ও সুখ-স্বাচ্ছান্দ্যের জিনিস ভোগ ও ব্যবহার করা আল্লাহর বন্দেগীর পরিপন্থী নয় এবং আল্লাহর ইবাদাত করতে হলে এগুলো বর্জন করতে হবে এরূপ মনে করা একেবারেই ভিত্তিহীন। আবার ইসলাম দুনিয়া ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদী মানসিকতাকেও আদৌ সমর্থন করে না। আয়াতের শেষে বলা হয়েছে “জানিয়ে দাও, এইসব কিছুই এ দুনিয়ার জীবনে ঈমানদার লোকদের ব্যয়-ব্যবহার ও ভোগ-সম্ভোগের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (আরাফ: ৩২)


কিন্তু ইসলাম যে ব্যাপারটিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে সেটি হলো উভয় অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। একদিকে তার রিজক্ অন্যদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি- দুটো বিষয়ের মধ্যে সমান্তরাল অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। কুরআন ও হাদীসে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও সৌন্দর্য তথা সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্যে একসঙ্গে প্রার্থনা করার শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বলে: হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এই দুনিয়ার জীবনেই দাওঃ এদের জন্যে পরকালে কিছুই প্রাপ্য নেই। আবার এ লোকদের মধ্যে অনেকেই দো’আ করে এই বলে: ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে দুনিয়ায়ও কল্যাণ ও সুন্দর দান কর- সুন্দর ও কল্যাণ দান করো পরকালেও। এ লোকেরাই তাদের উপার্জনের অংশ পাবে। আর আল্লাহ খুব দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” (সুরা বাকারা: ২০০-২০২) একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ইহকাল ও পরকাল অবিভাজ্য। যারা একটিমাত্র কালকে চাইবে, তারা শুধুমাত্র অপরটি থেকেই নয়, দুটি থেকেই বঞ্চিত হবে।


দুনিয়ায় শুধু ধন-সম্পদের প্রাচুর্যই ইসলামের কাম্য নয়, বৈষয়িক উন্নতিও উন্নতির আসল মানদণ্ড নয়। ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য পরকালীন কল্যাণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা তো কেবল বৈষয়িক জীবনকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে কর। অথচ পরকালীন জীবনটাই আসল-কল্যাণের প্রকৃত ক্ষেত্র এবং সেটাই চিরস্থায়ী।” “তোমরা তো দুনিয়ার অস্থায়ী ও ক্ষয়িষ্ণু দ্রব্যাদি লাভ করতে চাও; কিন্তু আল্লাহ (তোমাদের জন্যে) চান পরকাল। আর আল্লাহ সর্বজয়ী ও সুবিজ্ঞানী।” (সুরা আনফাল: ৬৭) “তোমরা পরকাল বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়ার জীবন পেয়েই খুশীতে বাগ বাগ হয়ে গেলে?ঃ. কিন্তু আসলে পরকালের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের সমস্ত সামগ্রী নিতান্তই স্বল্প-অপর্যাপ্ত।” (সুরা তওবা: ৩৮) এ প্রেক্ষিতে পরকালকে উপেক্ষা করে কেবল বৈষয়িক জীবনের উন্নতি-উৎকর্ষ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের জ্ঞানলাভ কখনো যথার্থ ও কল্যাণকর নীতি হতে পারে না। মানুষের জন্য একমাত্র কল্যাণকর বিষয় হলো ইহকাল ও পরকাল উভয়ের সার্বিক কল্যাণ একসাথে হতে হবে।


আমরা যদি আম্বিয়ায়ে কেরামদের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব তাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে দো’আ করেননি বরং তাঁদের পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্তুতির জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের দো’আ করেছেন। চলুন মুসলিম মিল্লাতের পিতা ও নেতা হযরত ইবরাহিমের আ: দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করি। আল্লাহ তা’আলা তাঁর এ প্রিয় বান্দার উক্তি আল কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, “হে আমার রব! আমাকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী করো এবং আমার সন্তানদের। হে আমার রব! তুমি দো’আ কবুল কর। (ইব্রাহিম-৪০) তাঁর আরো ক’টি উক্তি আল কুরআনে বিবৃত হয়েছে “স্মরণ কর যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল তারা দো’আ করছিল ‘হে আমাদের রব! আমাদের এ কাজ কবুল কর। তুমি সব কিছু শোন ও জান। হে রব! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত (মুসলিম) বানাও। আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল বানাও। আমাদেরকে পদ্ধতি বলে দাও, আমাদের দোষত্রুটি দূর করে দাও। নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। (বাকারা ১২৭-১২৮) একই সুরার ১৩২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তাঁর (ইব্রাহিমের) রব যখন বললেন আত্মসমর্পণ কর, তখনি বলেন আমি বিশ্ব প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। ইব্রাহিম এ পথে চলার জন্য তার সন্তানদের নির্দেশ দিয়ে ছিলেন ইয়াকুবও। তারা বলেছিলেন, হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে মনোনীত করেছেন সুতরাং মৃত্যু পর্যন্ত তোমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাকবে।” আল কুরআন আরো বলছে, “যখন ইয়াকুবের মৃত্যু সময় উপস্থিত হয় তখন তোমরা কি সেখানে উপস্থিত ছিলে? মৃত্যুর সময় সে তার সন্তানদের বলল হে পুত্রগণ! আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদাত করবে? তারা সকলেই উত্তর দিয়েছিল আমরা সেই এক আল্লাহর ইবাদাত করবো যাকে আপনি ও আপনার পূর্ব পুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাঈল ও ইসাহাক মেনে নিয়েছিলেন আমরা সবাই তারই অনুগত (আমরা মুসলমান)।” (বাকারা ১৩১-১৩২)


উল্লেখিত আয়াতগুলোর মর্মস্পর্শী আবেদনগুলো সামনে রেখে উপলব্ধি করুন। মনে করুন আমার বা আপনার সন্তানটি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার, একজন দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, একজন উঁচুমানের ইঞ্জিনিয়ার, বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে যার নাম উচ্চরিত হয় এমনকি দেশের গণ্ডি বা সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু আপনার সোনার ছেলেটি ইসলামী অনুশাসন জ্ঞান নেই, ইসলামী অনুশাসন মানে না ও ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় সে এখনো অংশগ্রহণ করে নাই। বলুন তার এ খ্যাতি কি ইসলামের কোন উপকারে আসবে? অথবা তার এ খ্যতি আপনার দুনিয়ার বাহ্বা ছাড়া আখিরাতে কি কোন উপকারে আসবে? তার এ শ্রেষ্ঠ মর্যাদার জন্য আপনার যে অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন, তার সামান্যই কি আল্লাহ তা’আলার বিবেচনায় আসবে? বরং এ সন্তান দিয়ে এতটুকু আশা আপনি করতে পারেন যে, সমাজ সংসারে হয়তো সে জুমাবারের একজন ট্রেডিশনাল মুসল্লি, বৎসরে একবার হুজুরদের ডেকে আপনার মৃত্যু বার্ষিকীতে মিলাদের আয়োজন করবে। পক্ষান্তরে আমি যদি অন্য একটি সন্তানের উদাহরণ এভাবে পেশ করি যা উপরোল্লেখিত বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠান সংগ্রামে অগ্রগামী। অথবা মধ্যবর্তী জীবন-যাপন করার জন্য যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন ততটুকু শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও অগ্রগামী। আপনার মৃত্যুর পর যে সারাক্ষণই ‘রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বা এয়ানি ছগিরা’ বলে দোয়া করে। বলুন তো কোন্ ছেলেটি শ্রেষ্ঠ?


ছেলে-মেয়েরা তাদের জীবনের মডেল হিসাবে পিতামাতাকে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু আপনি যদি এ ধারণা পোষণ করেন যে, ছেলেটি আপাতত লেখা-পড়া নিয়ে থাকুক, ইসলামী অনুশাসনের জন্য জীবনের আরো বহু সময় ও সুযোগ রয়েছে, তবে এটা একটা আত্মঘাতী কাজ হবে। এ ছেলেটি ভবিষ্যতে নামাজ ও রোযার অনুসারী হতে পারে বটে কিন্তু ইসলামী অনুশাসন কি তা সে জানতে পারবে না। তাই ছেলে-মেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠন করার নিমিত্তে লেখাপড়ার পাশাপাশি চরিত্র গঠনের পাঠশালাতেও তাকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা সুস্পষ্ট জুলুম হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং আপনার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে ইসলামী অনুশাসনে সম্পৃক্ত করুন। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template