শিশুকে উত্তমভাবে লালন-পালন করা পিতামাতা উভয়েরই কর্তব্য। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভদ্রতা-শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া, তার কাজ-কর্ম ও আচরণে ইসলামী রীতিনীতির প্রতিফলন ঘটানো এবং তাকে ইসলামী জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা পিতামাতা, অভিভাবক, মুরব্বি, আত্মীয়স্বজন সবারই কর্তব্য, লিখেছেনমোঃ বাকী বিল্লাহ
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেসব নেয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সন্তান-সন্ততি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাধ্যমে মানবজাতি দ্বারা পৃথিবীকে আবাদ রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা যে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা দান করেছেন তা হচ্ছে বিবাহভিত্তিক পরিবার গঠন করে সন্তান জন্মদান করা। সন্তানকে উপযুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে পিতামাতার ওপর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। সন্তানের সুস্বাস্থ্য অনেকটাই মায়ের সুস্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং অন্তঃসত্ত্বাকালে মায়ের চরিত্র ও মনমানসিকতা ভ্রুণের আত্মায় প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে এ সময় থেকেই অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের লক্ষ্যে পিতামাতা উভয়কেই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
মায়ের খাদ্য থেকেই ভ্রুণ ও নবজাতকের খাদ্য তৈরি হয়। এজন্য অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকালে তো বটেই, বরং সর্বাবস্থায়ই মায়ের জন্য হালাল ও সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করা পিতার কর্তব্য। অনাগত সন্তানের পরিপূর্ণ গঠন ও তার শারীরিক সুস্থতার জন্য অন্তঃসত্ত্বাকালে মায়ের স্বাস্থ্যের উপযুক্ত পরিচর্যা করা, পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, নিয়মিত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করাও পিতার কর্তব্য। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের কর্তব্য হচ্ছে ফরজ ইবাদতের সঙ্গে সাধ্যমতো নফল ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত, ইসলামী বইপত্র পাঠ ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করা। পিতামাতা উভয়েরই উচিত আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করা, যেন সন্তানটি নেক সন্তান হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতককে উত্তমরূপে গোসল করিয়ে (তবে শীতকালে খেয়াল রাখতে হবে, যেন শিশুর গায়ে ঠান্ডা লেগে না যায়) পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার শরীর মুছে দেয়া কর্তব্য। তারপর তার ডান কানের কাছে আজান ও বাম কানের কাছে একামত দেয়া সুন্নত, তথা ইসলামী রীতি। হজরত আবু রাফি (রা.) বলেছেন ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে দেখেছি, ফাতেমা (রা.) ও আলী (রা.) এর পুত্র হাসান (রা.) কে প্রসব করার পর তার কানে নামাজের আজানের মতো আজান দিয়েছেন।’ (সুনানে তিরমিজি ও আবু দাউদ)। এ হাদিসে শুধু আজানের কথা উল্লেখ থাকলেও হজরত হোসাইন (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদিসে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। এরপর নবজাতককে ‘তাহনিক’ করা সুন্নত। ‘তাহনিক’ হচ্ছে, (কোনো ভালো মানুষ কর্তৃক) খেজুর ভালো করে চিবিয়ে তার কিয়দংশ নবজাতকের মুখে দেয়া। খেজুরের অবর্তমানে কোনো মিষ্টান্ন দ্রব্য দ্বারাও তাহনিক করা যেতে পারে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে নবজাতক শিশুদের আনা হতো; তিনি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন এবং তাদের তাহনিক করতেন।’ (সহিহ মুসলিম)। নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিবসে তার নাম রাখা ও আকিকা করা পিতা বা অভিভাবকের ওপর কর্তব্য। নাম রাখার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা উচিত, নামটি যাতে ভালো হয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেয়ামত দিবসে তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের পিতার নাম ধরে (যেমনÑ হে অমুকের পুত্র অমুক) ডাকা হবে; অতএব তোমরা তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখবে।’ (সুনান আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেনÑ ‘কারও সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে আদব-কায়দা শিখায়।’ (বায়হাকি)। আকিকা হচ্ছে, সন্তান জন্মের পরিপ্রেক্ষিতে ছাগল, ভেড়া বা এ জাতীয় পশু জবেহ করা এবং আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে তাদের এর গোশত খাওয়ানো। পুত্রসন্তানের জন্য দুটি এবং কন্যাসন্তানের জন্য একটি পশু দিয়ে আকিকা দিতে হয়। এর গোশতের হকদার কেবল শিশুর পিতামাতাসহ অন্য আত্মীয়স্বজন। আকিকা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘শিশুর (ভূমিষ্ঠ হওয়ার) সঙ্গে আকিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর (পশু জবেহ কর) এবং তার থেকে কষ্ট দূরীভূত করো।’ (সহিহ বোখারি)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে ‘শিশু আকিকার সঙ্গে দায়বদ্ধ। তার পক্ষ থেকে (জন্মের) সপ্তম দিবসে জবেহ করা হবে এবং ওই দিনই তার নাম রাখা হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, নাসাঈ, আবু দাউদ)। আকিকার দিনেই শিশুর মাথা মু-ন করা কর্তব্য। মুন্ডিত চুলের ওজনের পরিমাণ রৌপ্যের মূল্য দান করে দেয়া মোস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হাসান (রা.) এর আকিকা নিজেই করে দিয়েছিলেন এবং ফাতিমা (রা.) কে তাঁর মাথা মু-ন করে এভাবে দান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মর্মে হাদিসে উল্লেখ আছে। নবজাতককে দুই বছর পর্যন্ত স্তন্যদান করা মাতার কর্তব্য। আর মাতাসহ শিশুর খোরপোষের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা পিতার কর্তব্য। আল্লাহ বলেছেন ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর স্তন্যদান করবে, যে স্তন্যদানের পূর্ণ মেয়াদ সম্পন্ন করতে চায়, আর সন্তানের অধিকারী (পিতার) ওপর তাদের খোরপোষের দায়িত্ব রয়েছে, ন্যায়সঙ্গতভাবে।’ (আল কোরআন, সূরা আল বাকারা : ২৩৩)। শিশুকে উত্তমভাবে লালন-পালন করা পিতামাতা উভয়েরই কর্তব্য। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভদ্রতা-শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া, তার কাজ-কর্ম ও আচরণে ইসলামী রীতিনীতির প্রতিফলন ঘটানো এবং তাকে ইসলামী জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা পিতামাতা, অভিভাবক, মুরব্বি, আত্মীয়স্বজন সবারই কর্তব্য। তবে প্রধানত পিতামাতাকেই এ কাজে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হয়। শিশু জন্মের সময় তার হৃদয়ে সত্য তথা ইসলামকে গ্রহণ করার যোগ্যতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। পিতামাতার দায়িত্ব হচ্ছে, তার হৃদয়ে বিদ্যমান এ মৌলিক যোগ্যতাকে মূলধারায় প্রবাহিত করার জন্য তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ ‘প্রত্যেক শিশুই ফিতরাতের (স্বভাবধর্ম) ওপর জন্মগ্রহণ করে (ইসলামকে গ্রহণ করার যোগ্যতা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়)। তারপর তার পিতামাতা (ইহুদি হলে) তাকে ইহুদি বা (খ্রিস্টান হলে) খ্রিস্টানে অথবা (অগ্নিপূজক হলে) অগ্নিপূজকে পরিণত করে।’ (বোখারী ও মুসলিম)। অতএব মুসলিম পিতামাতার ওপর সন্তান জন্মদানের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সন্তানের চরিত্র গঠনে যতœবান হওয়া এবং তাকে ইসলামী জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে ভালো মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
Post a Comment