মারের আঘাতে গোলামটি চিত্কার করছিল।
কোনো একটি অপরাধের কারণে নিজের এক ক্রীতদাসকে মারছিলেন আবু মাসউদ আনসারী (রা.)। এমনিতে তিনি সহনশীল, মমতাবান ও হৃদয়ের মূল্যায়নকারী একজন মানুষ। অত্যাচার, নিপীড়ন কিংবা শোষণ তার স্বভাবের অন্তর্গত নয়। তথাপি নিজের ক্রীতদাসের প্রতি তার রাগ ও ক্রোধটাকে তিনি সংবরণ করতে পারেননি। অনেক সময়ই যেমন হয়, মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম হয় না। ধৈর্যের বাঁধভাঙা স্রোতে যখন অসহিষ্ণুতার শ্যাওলা এসে ভিড় করে। তখন বিচার-বিবেচনা ও সৌজন্যের সুউচ্চ মিনার থেকে কিছুক্ষণের জন্য মানুষ মাটির সমান্তরালে চলে আসে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজনেরও ব্যবধান লোপ পেয়ে যায় অনেকাংশে; ক্রীতদাসের ব্যাপার তো আরও দূরে।
এমনই কিংবা এরই কাছাকাছি এক অবস্থায় আবু মাসউদ আনসারী (রা.)। প্রহার করছেন তিনি তার ক্রীতদাসকে, এ সময়েই সেখানে তাশরিফ আনলেন হজরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মমতা ও দয়ার একটি সফেদ আকাশ যাঁর বুকের মধ্যে আশ্রয় গেড়ে বসে আছে, সেই শ্রেষ্ঠতম মানব এক ক্রীতদাসের প্রতি একজন মনিবের ক্রোধ লক্ষ্য করলেন। মার খাওয়া ক্রীতদাসের বেদনা-যন্ত্রণা লক্ষ্য করলেন। একজন মানুষের কাছে অন্য একজন মানুষের করুণ অসহায়ত্ব লক্ষ্য করলেন। ব্যথায় ব্যথায় তার হৃদয় আকাশে কালো মেঘ জমে উঠল। দুনিয়ার, সব মজলুমের অসহায়ত্ব শুষে, সমব্যথী স্বরে তিনি শুধু বললেন—
‘আবু মাসউদ! এই ক্রীতদাসের ওপর তোমার যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, তোমার ওপর আল্লাহতায়ালার ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘না তুমি মার বন্ধ করো। তোমার এ কাজ খুব খারাপ।’ তিনি শুধু একজন মুমিনকে, একজন সাহাবিকে স্মরণ করিয়ে দিলেন আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার কথা, জাগিয়ে দিলেন একজন মুমিনের হৃদয়ে পরকালে জবাবদিহিতার ভীতি, সৃষ্টি করলেন জুলুমের পরিণতির ভয়াবহ আশঙ্কা। এর চেয়ে বেশি তো কিছু নয়! সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে কেঁপে উঠলেন আবু মাসউদ (রা.)। মাটির সমান্তরাল থেকে এক দৌড়ে উঠে এলেন আত্মনিয়ন্ত্রণের সুউচ্চ মিনারে। ধৈর্যহীনতার শ্যাওলার সব জঞ্জাল সরিয়ে আত্মার বিশুদ্ধ এক পুকুরে যেন অবগাহন করে উঠলেন। অনুশোচনা, অনুতাপ আর ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলেন। অনতিবিলম্বে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এই ক্রীতদাসকে এখন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, স্বাধীন করে দিলাম।’
দম বন্ধ অবস্থায় ভয়াবহতা থেকে যেন দম ফিরে পাওয়ার অনুভূতি, ডুবে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়ার আকুতি আর হারিয়ে যেতে যেতে পথ চিনে নিঃশ্বাস ছাড়ার আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে আবু মাসউদ (রা.)-এর মুখে। তার কথা শুনলেন, তার দিকে লক্ষ্য করলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাওয়া মানবতার ভুবন যিনি আবার গড়ে তুলেছেন, শোষক আর জান্তব মানবাচরণে যিনি ইছলাহের শৃঙ্খল বসিয়েছেন, মজলুম ও জালিমকে বাঁচানোর ব্যতিক্রমী, বিস্ময়কর ফরমান যিনি শুনিয়েছেন, সেই হাবিবে খোদা (সা.) এবার বললেন ভরাট কণ্ঠে—
‘এমন না করলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে স্পর্শ করত।’
শান্তি ও শাস্তির কথা তার পবিত্র মুখে পাশাপাশি আন্দোলিত হয়, প্রত্যাশা ও ভীতির কথা তার মুবারক জবানে পাশাপাশি উঠে আসে। তিনি মুক্তির অনন্য সওগাত নির্লিপ্তভাবেই বিতরণ করে যান। আবু মাসউদ (রা.) হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। জুলুমের দায় থেকে, জাহান্নামের আগুনের ছোবল থেকে বেঁচে যাওয়ায়, তাঁর চেহারায় অনুতাপ ও বিগলনের পাশাপাশি ইতমিনানের শুভ্র আবীর ছেয়ে গেল।
মার খাওয়া ক্রীতদাস অবাক হয়ে দেখল, সে এখন স্বাধীন।
-শরীফ মুহাম্মদ
Home
রাসূল(সাঃ)
নবী জীবনের ঘটনা ইতমিনানের শুভ্র আবীর
Post a Comment