السلام عليكم

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (তওবা) করবে আল্লাহ তাকে সব বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। [আবূ দাঊদ: ১৫২০; ইবন মাজা: ৩৮১৯]

ই’তিকাফের বিবরণ

| comments

তারাবীহ, সাহারী, ইফতারের পর রমজানের চতুর্থ অবদান ই’তিকাফ। তাই আজ ই’তিকাফ সংক্রান্ত আলোচনা করা হল। আরবী ই’তিকাফ শব্দটি উকূফ ধাতু থেকে নির্গত। উকূফ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ কোন জিনিস বা জায়গাকে আঁকড়ে ধরা ও চিমটে থাকা।

(নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীস ৩য় খণ্ড-১৩৬ পৃষ্ঠা) ইসলামী পরিভাষায় ই’তিকাফের অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোন মসজিদে নিজেকে বন্দী রাখা। (আল মুফরাদা-তু ফী গারীবিল কুরআন-৩য় খণ্ড, ১৩৪ পৃঃ) আল কুরআনের প্রায় আট জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহƒত হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “আমি ইবরাহীম, ইসমাঈলকে বিশেষ হুকুম দিয়েছি আমার ঘরকে পবিত্র রাখার জন্য তাওয়াফকারী ও ই’তিকাফকারীদের উদ্দেশ্যে।” (সূরা বাকারা ২ ঃ ১২৫ আয়াত) “তোমরা মাসজিদে ই’তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হবে না।” (সূরা বাকারা ২ ঃ ১৮৭ আয়াত) “তারা তাদের প্রতিমাগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিল।” (সূরা আ’রাফ ৭ ঃ ১৩৮ আয়াত) আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন জাতির নিকট ই’তিকাফ একটি ‘ইবাদাত ছিল। তাই তারা তাদের অলীকে উপাস্যের সামনে ই’তিকাফ করতো। মাক্কার মুশরিকরাও ই’তিকাফ করতো। যেমন ওমর (রা.) একবার নবীকে (স.) বলেন যে, আমি একবার (কাফিরী যুগে) মাসজিদুল হারামে একরাত ই’তিকাফ করবো বলে মানত করেছিলাম। নবী (স.) বললেন: তাহলে তুমি তোমার মানত পূরণ কর। (বুখারী-২৭২ ও ২৭৪ পৃঃ মুসলিম, মিশকাত-১৮৩ পৃঃ) এবং রোযা রাখ। (আবূ দাউদ-১ম খণ্ড, ৩৩৬ পৃ:)

রাসূলুল্লাহ (স.)-এর ই’তিকাফ:রাসূলুল্লাহ (স.) নবী হবার আগে পরপর কয়েকদিন ধরে হেরা পাহাড়ের এক গুহায় ই’তিকাফরত অবস্থায় আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। (বুখারী-১ম পৃ:)

নবী হবার পর তিনি (স.) প্রত্যেক রমজানের দশদিন করে ই’তিকাফ করতেন। অতঃপর যে বছরে তিনি ওফাত পান সেই বছরে বিশদিন ই’তিকাফ করেন। (বুখারী-২৭৪ পৃঃ, আবূ দাউদ-১ম খণ্ড-৩৩৪ পৃ:, ইবনে খুযায়মা-৩য় খণ্ড-৩৪৪ পৃ: মিশকাত-১৮৩ পৃ:, বায়হাকী, ৪র্থ খণ্ড, ৩১৪ পৃ:)

কেবল নবী (স.) একা নন, বরং তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর স্ত্রীরাও ই’তিকাফ করতেন। (বুখারী-২৭১ পৃ:, মুসলিম-১ম খণ্ড-৩৭১ পৃ: আবূ দাউদ-১ম খণ্ড-৩৩৪ পৃ: মিশকাত-১৮৩ পৃ:) এক বছর ই’তিকাফের ব্যাপারে তাঁর সহধর্মিনীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়ায় সে বছর তিনি করেননি। কিন্তু ঐ ছাড় যাওয়া ই’তিকাফটি তিনি ঐ বছরেই রমজানের পরের মাসে শাওয়ালের শেষ দশ দিনে কাযা ই’তিকাফ করে দেন। (বুখারী-২৭২, ২৭৩, ও ২৭৪, ইবনে মাজা-১২৮ পৃ:) নবী (স.) প্রত্যেক বছরে রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। অতঃপর এক বছর তিনি ঐ সময়টা সফরে থাকায় ই’তিকাফ করতে পারেননি। তাই পরের বছরে বিশদিন ই’তিকাফ করেন। (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩য় খণ্ড-৩৪৬ পৃ:-ইবনে মাজা-১২৭, মুস্তাদরকে হাকিম, ১ম খণ্ড, ৪৩৯ পৃ: তালখীসুল হাবীর-১৯৩ পৃ: বায়হাকী-৪র্থ খণ্ড-৩১৪ পৃ:) ই’তিকাফের ফজিলত ও মাহাত্ম্য ই’তিকাফকারী সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স.) বলেনঃ ঐ ব্যক্তি বহু পাপ থেকে বিরত থাকে এবং তাকে এত নেকী দেয়া হয় যত নেকী অন্যান্য সবরকম ভাল কাজের কাজীকে দেয়া হয়। (ইবনে মাজা -১২৮ পৃ:, মিশকাত-১৮৩ পৃ: বায়হাকী, দুররে মনসুর-১ম খণ্ড-২০১ পৃ:) অন্য একটি হাদীসে আছে, রসূলুল্লাহ (স.) বলেন :যে ব্যক্তি রমজানের দশ দিন ই’তিকাফ করলো সে যেন হজ্জ ও দুই ‘উমরা করলো। (বায়হাকী, দুররে মনসুর-১ম খণ্ড,২০২ পৃ:) নবী (স.) বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মাত্র একটি দিন ই’তিকাফ করবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে এমন তিনটি গর্ত করে দেবেন যার দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী ব্যবধানের মত হবে। (তাবারানী আওসাত, হাকিম, বায়হাকী, তারীখে বাগদাদ, তাফসীর দুররে মনসুর-১ম খণ্ড-২০২)

তাবেঈ নেতা হাসান বসরী (রহ.) থেকে বর্ণিত, ই’তিকাফকারীর জন্য প্রত্যেক দিনের বদলে একটি করে হাজ্জের নেকী রয়েছে। (তাবারানী আওসাত, হাকিম, বায়হাকী,তারীখে বাগদাদ, তাফসীর দুররে মনসুর-১ম খণ্ড-২০২)

ই’তিকাফের গুরুত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল প্রিয় নবী (স.)-এর আজীবন ই’তিকাফ করা এবং তাঁর সহধর্মিণীদের প্রতিযোগিতা ও তাঁর সফরের কারণে দুবার তাঁর ই’তিকাফ ছাড় যাওয়ায় ঐ ই’তিকাফ পুনরায় করে দেয়া। সেজন্য সুন্নাতে নববীর প্রত্যেক আশেকের পক্ষে পারতপক্ষে মহানবী (স.)-এর এ সুন্নাত পালন করা উচিত।

ই’তিকাফের জায়গা মাসজিদে হওয়া চাই: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: তোমরা মাসজিদে ই’তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হইও না। (সুরা বাকারা ২ঃ ১৮৭ আয়াত) এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, ই’তিকাফ মাসজিদে হবে। (তাফসীর মাযহারী ১ম খণ্ড ২০৮ পৃ:) নাফি’ (রা.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) আমাকে মসজিদের (নববীর) সেই বিশেষ জায়গাটি দেখিয়েছেন যেখানে রাসুলুল্লাহ (স.) ই’তিকাফ করতেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড ৩৭১ পৃ: আবু দাউদ ১ম খণ্ড ৩৩৪ পৃ:) আয়েশা (রা.) বলেন, সিয়াম ছাড়া ই’তিকাফ নেই। (আবু দাউদ ১ম খন্ড ৩৩৫পৃ:) ইবনে ওমর ও ইবনে আব্বাসও তাই বলেন। (মুসান্নাফ আ: রাযযাক ৪র্থ খন্ড ৩৫৩ পৃ: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ৩য় খণ্ড ৮৭ পৃ: বায়হাকী ৪র্থ খন্ড ৩১৮ পৃ:)

ই’তিকাফ কত প্রকার ও কত সময়: বিভিন্ন হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, ইতিকাফ তিন রকম:

১। ওয়াজিব, ২। সুন্নাত ৩। নফল। কেউ যদি মানত করে যে, সে ই’তিকাফ করবে তাহলে ঐ ইতিকাফ তার উপর ওয়াজিব হয়ে যাবে। যেমন নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মানত করে সে যেন তা অবশ্যই পূরণ করে। (বুখারী মিশকাত ২৯৭ পৃ:) এ ওয়াজিব পালন না করলে তাকে কসম ভঙ্গের শরয়ী জরিমানা দিতে হয় যেমন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মানতের জরিমানা কসম ভঙ্গেরই জরিমানা। (মুসলিম, মিশকাত ২৯৭) । তাই ওমর (রা.) যখন নবীকে (স.) জিজ্ঞস করেন যে, আমি জাহেলী যুগে একবার মসজিদুল হারামে এক রাত ই’তিকাফ করার মানত করেছিলাম তখন (স.) বললেন: তাহলে তুমি তোমার মানত পূরণ কর। (বুখারী, মুসিলম, মিশকাত ১৮৯ পৃ:)

ফলে তিনি একরাত ই’তিকাফ করলেন। (বুখারী-২৭৪ পৃ:) এ ওয়াজিব ইতিকাফের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। মানতকারী যতক্ষণের মানত করবে ওর সময়সীমা ততক্ষণ হবে। (ফিকহুস সুন্নাহ ১ম খন্ড-৪৭৬ পৃ:)।

সুন্নাতী ই’তিকাফ: ‘আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (স.) রমজানের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করতেন পরিশেষে আল্লাহ তাঁকে ওফাত দেন। তারপর তাঁর সহধর্মিনীগণও ই’তিকাফ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত-১৮৩ পৃ:) কেবল তাঁর ওফাতের বছরে তিনি (স.) বিশ দিন ই’তিকাফ করেছিলেন। (বুখারী-২৭৪ পৃ: মিশকাত-১৮৩ পৃ:, আবূ দাউদ ১ম খণ্ড-৩৩৪ পৃ:) এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, সুন্নাতী ই’তিকাফের সময়সীমা কমপক্ষে দশদিন এবং এর বেশি হলে বিশ দিন।

ই’তিকাফের শুরু ও শেষ কখন: মুস্তাহাব ই’তিকাফের জন্য ই’তিকাফের জায়গায় প্রবেশের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। ই’তিকাফকারী যখন আল্লাহর নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে মাসজিদে ঢুকবে সে তখন থেকেই ই’তিকাফকারীরূপে গণ্য হবে যতক্ষন না সে মাসজিদে থেকে বের হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ ১ম খন্ড ৪৭৯ পৃ:) কিন্তু কেউ যদি রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফের ইচ্ছা করে তাহলে সে সূর্য ডোবার একটু আগে ই’তিকাফের খাস জায়গায় প্রবেশ করবে। ই’তিকাফরত অবস্থায় ই’তিকাফকারীর উচিত খুব বেশী নফল ইবাদাত করা। যেমন-সালাত, তেলাওয়াতে কুরআন, বিভিন্ন রকম তাসবীহ, তওবা ও এস্তেগফার, নবীর উপরে দরূদ ও দু’আ প্রভৃতি কাজের মধ্য মগ্ন থাকা। যাতে করে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায় এবং স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে উঠে! এরই মধ্যে গণ্য হবে ধর্মীয় কিতাব পড়া, কুরআন ও হাদীস চর্চা করা, নবী ও সৎ লোকের জীবনীগ্রন্থ অধ্যয়ন করা প্রভৃতি কাজ। (ফিকহুস সুন্নাহ ১ম খন্ড-৪৮০ পৃ:) আত্মগর্ব নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যদি ই’তিকাফকারী কাউকে কুরআন পড়ায়, দীনী শিক্ষা দেয় ও হাদীস লেখে তাহলে তা চলবে। (আলমুগনী ৪র্থ খণ্ড-২০৪ পৃ:) ই’তিকাফকারীর মাথা আঁচড়ানো, নখ-চুল কাটা, ময়লা থেকে দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখা, খুশবু মাখা ও ভাল ভাল কাপড় চোপড় পরাতে কোন আপত্তি নেই। যেমন ‘আয়েশা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ই’তিকাফরত অবস্থায় আমাকে তাঁর মাথাটা এগিয়ে দিতেন। আমি হুজরার ফাঁক দিয়ে তাঁর মাথাটা ধুয়ে দিতাম। মুসাদ্দাদের বর্ণনায় আছে, আমি তাঁর মাথা আঁচড়ে দিতাম। (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, ফিকহুস সুন্নাহ ১ম খন্ড-৪৮১ পৃ:)

গ্রন্থনা:

০০ মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
Share this article :

Post a Comment

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. ইসলামী কথা - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Premium Blogger Template