জীবন যাপন করতে গেলে পানাহার করতে হয়। ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবনবিধান। পবিত্র ধর্ম ইসলাম আমাদেরকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পানাহারের শিষ্টাচারও শিক্ষা দেয়। নবী করিম সা: তাঁর সাহাবিদের পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্খ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে তা নিজে করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর সাহাবিদের বলেছেন খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতে, বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করতে, ডান হাত দিয়ে খেতে, ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত না খেতে, অতিরিক্ত পানাহার না করতে এবং খাওয়ার শেষে আল্লাহর প্রশংসা করতে বলেছেন। ইসলামী নিয়ম মতো খাওয়া-দাওয়া করলে তা হয় অন্য ইবাদতের মতো ইবাদত। নবী করিম সা: পানাহারের ব্যাপারে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতেন।
নবী করিম সা: কখনো খাবারের খুঁত ধরতেন না। খাবার আল্লাহর নিয়ামত। খুঁত না ধরে তার প্রশংসা করা উচিত। তাতে বরকত হবে। খাবারের খুঁত ধরলে তা মানসিক ও সাংসারিক অশান্তির কারণ হতে পারে। খাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সা: দোয়া পড়তেন ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি মা রাজ্জাকতানা ওয়াকিনা আজাবান্নার’ হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে যে খাবার দিয়েছ তাতে বরকত দান করো এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুনের আজাব থেকে রক্ষা করো। অথবা সংক্ষেপে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করা। (আন-নাসাই)।
খাওয়ার আগে হাত ধোয়া আবশ্যক। তা না হলে পেটে জীবাণু যাবে। উদরাময়, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েডসহ নানা অসুখ হতে পারে। বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য আজকাল হাত ধোয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সা: খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার তাগিদ দিয়েছেন। (বুখারি)। খোলা পানীয় ও খাবার খাওয়া স্বাস্খ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাসূলুল্লাহ সা: খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় ঢেকে রাখতে বলেছেন। (বুখারি)।
খাওয়ার পরে বলতে হয় : আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আতআমানা ওয়া সাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাকে খাবার ও পানীয় দিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলমান বানিয়েছেন অথবা সংক্ষেপে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা। (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
কম খাওয়া রাসূলেপাক সা:-এর সুন্নত। পরিমিত খাবার খাওয়া স্বাস্খ্যের জন্য ভালো। বেশি খেলে রক্তে চর্বি বাড়ে। শরীরে মেদ জমে, শরীর বেশি মোটা হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি রোগ হয়। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। হজরত মুহাম্মদ সা: রোগ-শোক প্রতিরোধ তথা সুন্দর স্বাস্খ্যের জন্য কম খাওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকস্খলীর এক ভাগ খাবারের জন্য, এক ভাগ পানির জন্য আর এক ভাগ বাতাসের জন্য। (তিরমিজি, ইবনে মাজা)। ধীরে ধীরে খাওয়া সুন্নত। ধীরে-সুস্খে খাওয়া স্বাস্খ্যসম্মত। তাতে খাবার ভালো করে চিবানো হয়। মুখের লালা খাদ্যের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারে। হজম সহজতর হয়। খাবার বিচূর্ণ করতে পাকস্খলীর ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না। বুকজ্বলা কম হয়। ধীরে ধীরে খেলে খাওয়ার সময়ই কিছু খাবার হজম হয়ে রক্তে চলে যেতে পারে। এতে ক্ষুধাও কিছুটা নিবৃত হয়। ফলে কম খাবার খেলেই ক্ষুধা মিটে যায়। হুজুর সা: তিন আঙুলে খেতেন এবং খাওয়ার পর জিহ্বা দিয়ে আঙুল চেটে খেতেন। (বুখারি, মুসলিম)। অর্থাৎ তিনি খুব ধীরে-সুস্খে খেতেন। একসাথে বেশি খাবার মুখে দিতেন না। অতিরিক্ত গরম খাবার খাওয়া ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সা: খাবার ঠাণ্ডা করে খেতে বলেছেন। (আবু দাউদ)। বেশি গরম খাবার খেলে খাদ্যনালীর ক্ষতি হয়। হুজুর সা: খাদ্য ও পানীয়তে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। (রাওয়াহে তিবরানি)। ফুঁ দিলে মুখ থেকে রোগজীবাণু খাদ্য বা পানীয়তে ঢুকে যেতে পারে।
বর্তন ও আঙুল চেটে খাওয়া সুন্নত। চেটে খেলে আমরা খাদ্যের সব উপকারী উপাদানই পেতে পারি। (মুসলিম)। হুজুর সা: আঙুল ও বর্তন চেটে খেতে বলেছেন। খাদ্যের কোন অংশে কল্যাণ নিহিত, তা আমরা জানি না। (মুসলিম)। বর্তন চেটে খেলে তা খাদ্য গ্রহণকারীর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। (তিরমিজি)। খাবার ভাগ করে খাওয়া সুন্নত। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, দু:খী-ভুখা এদের সাথে খাবার ভাগ করে খাওয়ার ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, সে ঈমানদার নয় যে নিজে পেটপুরে খেল, কিন্তু তার প্রতিবেশী উপবাস থাকল। (বুখারি)। খাবারের সাথীর অনুমতি না নিয়ে দু’টি খেজুর একসাথে খাওয়াও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (বুখারি)। খাবার ভাগ করে খাওয়ায় ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। একসাথে খাওয়া সুন্নত। একসাথে খাওয়া পরস্পরের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্য আনে। একসাথে খেলে খাবারে বরকত হয়। (ইবনে মাজা)। দাঁড়িয়ে, হেলান দিয়ে বা শুয়ে খাওয়া উচিত নয়। এতে খাবার গলায় আটকে যেতে পারে, শ্বাসনালীতে ঢুকে যেতে পারে। নবী করিম সা: বালিশে বিশ্রাম নেয়া অবস্খায় খাবার খেতেন না। (বুখারি)। খাওয়ার পরে হাত ধোয়া উচিত। তা না হলে তাতে রোগজীবাণু বংশ বৃদ্ধি করবে। হাদিস শরিফে এসেছে, খাওয়ার পরে হাত না ধুয়ে ঘুমালে যদি কারো কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তার জন্য সে নিজেই দায়ী। (তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)। স্বাস্খ্যকর উপায়ে পরিমিত খাবার খাওয়ার কথা বিজ্ঞান আজ বলছে। নবী করিম সা: আজ থেকে ১৪০০ বছরেরও বেশি আগে এসব নিজে আমল করে গেছেন এবং তাঁর সাহাবিদের এতদসংক্রান্ত উপদেশ দিয়ে গেছেন। হুজুরেপাক সা:-এর সুন্নত অনুসরণ করে পরিমিত পানাহার করে আমরা সুস্খ জীবন যাপন করতে পারি।
লেখক : ডা. মো: শহীদুল্লাহ
বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি
মেডিসিন বিভাগ, কমিউনিটি বেজড
মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ
মে ১১, ২০১০
Post a Comment